৬ বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা খরচা, তবু ডুবছে চট্টগ্রাম শহর

৬ বছরে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও সুফল নেই। সময় যায়, খরচ বাড়ে, প্রকল্প শেষ হয় না। অপরিকল্পিত কাজ এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা।

জলাবদ্ধতা নিরসনে রেগুলেটর নির্মাণ করা হলেও পুরোপুরি চালু হয়নি। এতে জোয়ার ও ভারী বর্ষণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বুধবার চট্টগ্রাম নগরের চাক্তাই খালে
ছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান চারটি প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। গত ছয় বছরে এসব প্রকল্পের পেছনে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও নগরবাসী এর সুফল পাননি; বরং জলাবদ্ধতা এবার বেড়েছে। চলতি বছরের ৭ মাসে চট্টগ্রাম শহর ডুবেছে ১০ বার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত কাজ এবং সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে আগামী দুই বছরেও জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও বলছেন, শেষ মুহূর্তে এসে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া, ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রকল্প সংশোধন জটিলতার কারণে নির্মাণকাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে আগামী বছরের জুনে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রকল্পের মেয়াদ আরেক দফা বাড়াতে হবে।

চট্টগ্রাম নগরের দীর্ঘদিনের সমস্যা জলাবদ্ধতা দূর করতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দুটি, সিটি করপোরেশন একটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চার প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ছয় বছরে এসব প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৫ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা।

রেগুলেটরগুলোর নকশা চূড়ান্ত করা হলেও নানা জটিলতায় কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাঁরা আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন। তবে সংস্থাটির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, যে বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। মেয়াদ বাড়াতে হবে।
শিবেন্দু খাস্তগীর, প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী

এত বড় অঙ্কের টাকা খরচের পরও ৪ থেকে ৭ আগস্ট টানা চার দিন নগরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এতে নগরের ৪০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। অন্তত ১৫ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। ডুবে যায় মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বহদ্দারহাটের বাড়ির উঠান ও সামনের সড়কও। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্রতিবছর চট্টগ্রাম শহর এভাবে ১০ থেকে ১৪ বার ডুবে যায়।

শহর বারবার ডুবলেও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মূল দুই সংস্থা সিটি করপোরেশন ও সিডিএর মধ্যে সমন্বয় নেই; বরং জলাবদ্ধতার দায় একে অপরের কাঁধে চাপাতে ব্যস্ত। নগরে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজে সিডিএ সমন্বয় করছে না অভিযোগ তুলে ক্ষোভ জানিয়ে ৬ আগস্ট ফেসবুকে পোস্ট দেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, এই প্রকল্পে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নেই। তারা (সিডিএ) করপোরেশনকে কোনো কিছুই জানায়নি। ইচ্ছেমতো কাজ করছে। এত বড় একটি প্রকল্প, চট্টগ্রামবাসীর বাঁচা-মরারও প্রশ্ন, এরপরও তারা সমন্বয় করছে না।

৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে সিডিএর চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতার কাজ ঠিকভাবে করতে না পারায় তার দায়িত্ব সিডিএকে দেওয়া হয়েছে। মেয়রও ভুল তথ্য দিয়ে সিডিএকে দোষারোপ করছেন। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএর কোনো গাফিলতি নেই।

আরও পড়ুন

সিডিএর দুই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে দুই থেকে ছয় বছর পর্যন্ত। আবার মেয়াদ বাড়াতে হবে।

এই চারটি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্পটি হচ্ছে সিডিএর। ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার এই প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয় ২০১৭ সালের আগস্টে। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্পটি নেওয়া হয়। পরে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে।

খালগুলো পরিকল্পিতভাবে পুনঃখনন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। এই প্রকল্পের আওতায় নগরের ৩৬টি খাল খনন, এর দুই পাশে প্রতিরোধদেয়াল ও রাস্তা, নালা-নর্দমা ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, পাঁচটি খালের মুখে রেগুলেটর (জোয়ার প্রতিরোধক ফটক) স্থাপন এবং তিনটি জলাধার নির্মাণ। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন

প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ শেষ হলেও ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন করেছে সিডিএ। সংশোধিত ডিপিপিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক লাফে বাড়ছে ৩ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী আহমদ মঈনুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের আওতায় এখনো খালের দুই পাশে প্রতিরোধদেয়াল, সড়ক, ফুটপাত, সিল্টট্র্যাপ (বালু বা কাদা আটকানোর ফাঁদ) নির্মাণের কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে। এসব কাজ শেষ করতে অন্তত দুই বছর সময় লাগবে।

এই প্রকল্পের পাশাপাশি নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। নগরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমানো, যানজট নিরসন এবং কর্ণফুলী নদীর তীরের চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, বাকলিয়া, কল্পলোক আবাসিক এলাকা, কালামিয়া বাজার, কালুরঘাট শিল্প এলাকা, বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁও এলাকার জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে এই প্রকল্প নেয় সিডিএ। শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার কোটি টাকা। দুই দফা বৃদ্ধির পর এখন ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা।

এই প্রকল্পের আওতায় জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত ১২টি খালের মুখে ১২টি রেগুলেটর নির্মাণ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ চলছে ১০টির। এর মধ্যে চাক্তাই ও রাজাখালী খালে দুটি বড় রেগুলেটর রয়েছে। বাকি দুটি খালে কাজ শুরু হয়নি। এ ছাড়া ৯ কিলোমিটার সড়ক কাম বাঁধের মধ্যে সাত কিলোমিটারের মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। কিন্তু কাজের যে অগ্রগতি, তাতে এই সময়ে কাজ শেষ করা যাবে না, মেয়াদ বাড়াতে হবে।

১০ বছরেও শেষ হয়নি যে খালের কাজ

১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম নগরের জন্য প্রণয়ন করা ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনায় তিনটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খনন।

মূলত নগরের ২ নম্বর গেট, ষোলশহর, মুরাদপুর, শুলকবহর, বারইপাড়া, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, বাকলিয়া ও চাক্তাই এলাকায় জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য এই খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। প্রতিবছরই এসব এলাকা ভারী বর্ষণের সময় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে যায়।

২০১৪ সালের জুনে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল খননের অনুমোদন দিয়েছিল একনেক। ৯ বছর পার হয়ে ১০ বছর চললেও খালটির খননকাজ শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। ৩২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখন খরচ করতে হচ্ছে ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী গত রোববার অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভা শেষে জানান, তিন কিলোমিটারের মধ্যে এক কিলোমিটার অংশে খননকাজ চলছে। ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলে আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল নগরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে। প্রকল্পটির আওতায় কর্ণফুলী ও হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত ২৩টি খালের মুখে রেগুলেটর নির্মাণ; কিন্তু কাজ চলছে ১০টির।

বাকিগুলোর এখনো কাজ শুরু হয়নি বলে পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় ১৮ কিলোমিটার ফ্লাড ওয়াল নির্মাণের কথা থাকলেও বন্দরের বাধার কারণে ১২ কিলোমিটার অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৪৮ কোটি টাকা।

প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী শিবেন্দু খাস্তগীর প্রথম আলোকে বলেন, রেগুলেটরগুলোর নকশা চূড়ান্ত করা হলেও নানা জটিলতায় কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। তাঁরা আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন। তবে সংস্থাটির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, যে বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। মেয়াদ বাড়াতে হবে।

প্রথম আলোর অনুরোধে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার গত মঙ্গলবার চাক্তাই ও রাজাখালী খালসহ আটটি খালে চলমান কাজ পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জলাবদ্ধতা নিরসনে যেসব কাজে অগ্রাধিকার বা গুরুত্ব দেওয়ার কথা, তা দেয়নি। তাই অনেক কাজ হয়ে গেলেও মানুষ সুফল পাচ্ছেন না। অন্তত রেগুলেটরগুলো চালু, পাম্প স্থাপন, জলাধারগুলো ও সিল্টট্র্যাপগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করতে পারত। তাহলে জলাবদ্ধতা এমন ভয়াবহ হতো না।