চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম ও দলাদলিতে অস্থিরতা

গতকাল ও বুধবার ছাত্রলীগের ৩ দফা সংঘর্ষে আহত ২৪। নিয়োগে অনিয়ম, হলের নিয়ন্ত্রণ বেহাত, আন্দোলনে শিক্ষক সমিতি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় লাঠিসোঁটা ও রামদা হাতে নেতা-কর্মীরা। গতকাল দুপুরে শাহজালাল হলের সামনেছবি: সংগৃহীত

নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি, হলের নিয়ন্ত্রণ বেহাত, ছাত্রী নিপীড়ন, ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, অছাত্রদের দাপট—এসব এখন জড়িয়ে গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে তদারকি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বারবার চিঠি দিয়ে সতর্ক করলেও কোনো কাজ হয়নি। এদিকে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার দুই দফা ও আগের দিন বুধবার রাতে এক দফা ছাত্রলীগের সংঘর্ষে অন্তত ২৪ জন আহত হয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পাঠদান কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।

ছাত্রলীগের উপপক্ষ ‘চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার’ ও ‘সিক্সটি নাইন’ এর মধ্যে গতকাল রাত আটটায় সংঘর্ষ বাঁধে। দুই কর্মীর চায়ের দোকানে চেয়ারে বসা নিয়ে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত। সংঘর্ষ চলাকালে রাম দা ও ইটের আঘাতে আহত হন ছাত্রলীগের অন্তত ৯ নেতা–কর্মী। এর আগে গতকাল দুপুরে ও বুধবার রাতে দুই দফা সংঘর্ষ বাঁধে উপপক্ষ ‘বিজয়’ ও ‘সিক্সটি নাইন’ এর নেতা–কর্মীদের মধ্যে। এতে আহত হন ছাত্রলীগের অন্তত ১৫ নেতা–কর্মী।

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রশাসন এখন অনেক বেশি অনিয়মে জড়িত। আইন ও নিয়ম ভেঙে বর্তমান প্রশাসন একের পর এক নিয়োগ বোর্ড বসিয়েছে। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। হলের কোনো নিয়ন্ত্রণই কর্তৃপক্ষের হাতে নেই।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ

এদিকে প্রায় তিন মাস ধরে উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। আগে কখনো কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে এমন লাগাতার আন্দোলন শিক্ষক সমিতি করেনি।

সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রশাসন এখন অনেক বেশি অনিয়মে জড়িত। আইন ও নিয়ম ভেঙে বর্তমান প্রশাসন একের পর এক নিয়োগ বোর্ড বসিয়েছে। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে। হলের কোনো নিয়ন্ত্রণই কর্তৃপক্ষের হাতে নেই।

তবে ক্যাম্পাস সুষ্ঠুভাবে চলছে বলে দাবি করেছেন উপাচার্য শিরীণ আখতার। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনা করছেন।

আরও পড়ুন

নিয়োগে নানা অনিয়ম

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে অনিয়মের বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অর্থের মাধ্যমে নিয়োগের অভিযোগটি বহুল আলোচিত। গত এক দশকে বিভিন্ন বিভাগ-ইনস্টিটিউটে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ নিয়োগে দলীয় বিবেচনা এবং প্রভাবশালী শিক্ষক ও রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ ছিল বলে অভিযোগ আছে।

বর্তমান উপাচার্য শিরীণ আখতার ২০১৯ সালের জুনে দায়িত্ব নেন। তাঁর সময়েই নিয়োগ নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১২ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৫ জনকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার পছন্দ, ছাত্রলীগের নেতা ও কয়েকজন শিক্ষকের সুপারিশে এসব নিয়োগ দেওয়া হয় বলে তখন অভিযোগ ওঠে।

আমার সময়ে নিয়োগে অনিয়ম হয়নি। সুপারিশের মাধ্যমে কিছু নিয়োগ দিয়েছি, এটা সত্য। এ ছাড়া ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদেরও কিছু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সবার যোগ্যতা ছিল।
উপাচার্য শিরীণ আখতার

নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি আরও জোরালোভাবে উঠে আসে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেন নিয়ে ওই বছর পাঁচটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এসব ফোনালাপ ছিল উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের সঙ্গে দুজন নিয়োগ প্রার্থীর। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে কথোপকথন হয়েছিল। ফোনালাপ ফাঁসের পর খালেদ মিছবাহুলকে উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফারসি বিভাগের নিয়োগও বাতিল করা হয়।

আরও পড়ুন

বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সূত্র জানায়, বর্তমান উপাচার্যের আমলে অর্থাৎ ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত ৩৬৮ জনকে শিক্ষক ও কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষক ১৩০ জন। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে কর্মচারী পদে নিয়োগ দেওয়া হয় অন্তত ৩৫ জনকে। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত ৪৮ জন। যদিও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করেনি কর্তৃপক্ষ।

বর্তমান উপাচার্য শিরীণ আখতার ২০১৯ সালের জুনে দায়িত্ব নেন। তাঁর সময়েই নিয়োগ নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক হাসিনা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মে অভিযোগ ওঠার পর ইউজিসির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে। কিন্তু ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে অতিরিক্ত নিয়োগ ও অপ্রয়োজনে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাজেট দেওয়া হচ্ছে না।

সিন্ডিকেট সূত্র বলছে, কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী আছেন অন্তত ২০ জন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সাবেক সহসভাপতি সায়ন দাশ গুপ্ত, তামজিদ কামরান, শরীফ উদ্দিন মো. আল আমিন, আমিনুল ইসলাম, আবুল কাশেম, আলতাব হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক সালেহ একরাম, উপসম্পাদক শাহরিয়ার ইমন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. জিয়া, সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহফুজ আহমেদ, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শরীফুল ইসলাম, সাবেক উপ নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক অনুপম রুদ্র, সাবেক সদস্য মো. পারভেজ, শোয়াইবুল ইসলাম, সাবেক সহসভাপতি সবুজ মিয়া।

বাংলা ও আইন বিভাগে ‘জোর’ করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া নিয়ে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে প্রায় তিন মাস ধরে। গত ১৭ ডিসেম্বর উপাচার্যের বিরুদ্ধে অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে এ দুটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলে সমিতি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, গত বছরের ৪ মার্চ পাঁচটি বিভাগে ২৩ জনকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ পান সাতজন। ৩০ জানুয়ারি পাঁচটি বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয় ৩০ জনকে। বিজ্ঞাপিত পদের বাইরে নিয়োগ পান ছয়জন। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সর্বশেষ নিয়োগ অনুমোদন করা হয় গত ৩০ নভেম্বর। সেদিন নিয়োগ পান ৯ জন শিক্ষক ও ২৪ জন কর্মচারী।

নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে উপাচার্য শিরীণ আখতার গতকাল বলেন, ‘আমার সময়ে নিয়োগে অনিয়ম হয়নি। সুপারিশের মাধ্যমে কিছু নিয়োগ দিয়েছি, এটা সত্য। এ ছাড়া ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদেরও কিছু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সবার যোগ্যতা ছিল।’

শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিনটি সংগঠন রয়েছে। আওয়ামী ও বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ প্যানেল, জামায়াত ও বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সাদা দল এবং বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের একাংশের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম নামে পরিচিত। আবার হলুদ প্যানেলের শিক্ষকদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আর উপাচার্যপন্থী ও উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের একটি বলয়ও গড়ে উঠেছে।

বাংলা ও আইন বিভাগে ‘জোর’ করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া নিয়ে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে প্রায় তিন মাস ধরে। গত ১৭ ডিসেম্বর উপাচার্যের বিরুদ্ধে অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে এ দুটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলে সমিতি।

এরপর সমিতি উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে প্রতীকী অনশন, অবস্থান কর্মসূচি, গণসংযোগ, উপাচার্যের বিরুদ্ধে হওয়া অনিয়মের সংবাদ প্রদর্শন ও কর্মবিরতি পালন করেছে শিক্ষক সমিতি। বিপরীতে উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরা সমিতির বিরুদ্ধে মানববন্ধনও করেছেন।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক বলেন, সমিতি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন কিছুই করেনি। এ কারণে সমিতি উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। অবশ্য উপাচার্যের দাবি, সমিতির নানা পরামর্শ আমলে নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।

হল দখল-চাঁদাবাজিতে ছাত্রলীগ

ক্যাম্পাসের আবাসিক হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগের অনুমতির বিকল্প নেই। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবাসিক হলে আসন বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিল। ১৬ মাস পার হলেও কোনো শিক্ষার্থী আসন বরাদ্দ পাননি। এখনো হলের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হিসাবেই প্রায় ছয় হাজার ছাত্র হলে থাকতে দুই দফা আবেদন করেও আসন পাননি। কারণ, গত ছয় বছরে একবারও হলের আসন বরাদ্দ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার শর্তে আসন পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে হল রয়েছে ১৪টি, চালু আছে ১২টি (ছাত্রদের ৭, ছাত্রীদের ৫টি)। ছাত্রদের সাতটি হলে আসন রয়েছে ১ হাজার ৮৮টি। এর মধ্যে ১ হাজার কক্ষেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা থাকেন। বাকি কক্ষগুলোতে থাকেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগ সূত্র থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র বলছে, ছাত্রদের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ মূলত ৯ ছাত্রলীগ নেতার হাতে। শাহজালাল হলের একক নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগের উপপক্ষ ‘সিক্সটি নাইন’। এই উপপক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলাম ও শামসুজ্জামান চৌধুরী। আবার শাহ আমানত হল নিয়ন্ত্রণ করেন ‘চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার’–এর নেতা সাবেক সহসভাপতি মির্জা খবির। আলাওল হলের নিয়ন্ত্রণ বিজয় উপপক্ষের নেতা সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ইলিয়াছের হাতে। সোহরাওয়ার্দী, শহীদ আবদুর রব ও এ এফ রহমান হল এককভাবে কোনো পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে না। এই তিন হলের নিয়ন্ত্রণে আছেন সাবেক সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী, আবু বকর, মইনুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব। এঁদের কারও ছাত্রত্ব নেই।

এ ছাড়া মাস্টারদা সূর্য সেন হল নিয়ন্ত্রণ করে শাখা ছাত্রলীগের উপপক্ষ ‘এপিটাফ’–এর নেতা-কর্মীরা। এ উপপক্ষের নেতৃত্ব দেন সাবেক নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক সাজ্জাদ আনাম। ১০ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও এখনো তাঁর ছাত্রত্ব আছে বলে দাবি করেন।

গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর চাঁদাবাজি, সাংবাদিককে মারধর ও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের নানা ঘটনায় ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এরপরও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত ৩১ জানুয়ারি চাঁদা না পেয়ে ঠিকাদারকে হলের কক্ষে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের চার নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় হাটহাজারী থানায় চার নেতার নাম উল্লেখ করে মামলা করেন ভুক্তভোগী ঠিকাদার মো. তামজিদ উদ্দীন। এতে অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাত-আটজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। অভিযোগ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ৪ ফেব্রুয়ারি জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপাচার্যকে চিঠি দেয় ঠিকাদার সমিতি। ব্যবস্থা না নেওয়া হলে কাজ বন্ধের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মো. সেকান্দর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক এস এ খালেদ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এ চিঠিতে উল্লেখ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক আসক্ত অছাত্রদের চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। তাঁরা রড, ইটসহ সব নির্মাণসামগ্রী চুরিসহ প্রকাশ্যে ঠিকাদারদের গায়ে হাত তুলছেন।

প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার বলেন, ঠিকাদারেরা অভিযোগ দিলেও কারও নাম উল্লেখ করেন না। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে একটি ঘটনায় নাম উল্লেখ থাকায় প্রশাসন মামলা করেছে। আরেকটিতে ঠিকাদার নিজেই মামলা করেছেন।

ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে কোনো কমিটি নেই। তাই কে বা কারা সংঘর্ষ কিংবা ভাঙচুরে জড়িত, তা বোঝা যাচ্ছে না।

ছাত্রী নিপীড়ন বারবার

গত ১৭ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসে পাঁচ তরুণের হাতে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন ও মারধরের শিকার হন। পাঁচ তরুণ ওই ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু প্রতিবাদ করলে তাঁকেও মারধর করা হয়। এক দিন পর এ ঘটনায় হাটহাজারী থানায় মামলা হয়। আসামিদের গ্রেপ্তারও করা হয়। সর্বশেষ রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী বিভাগেরই এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তুলেছেন। ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর ধর্ষণচেষ্টার ওই অভিযোগ করা হয়।

 

‘অনিয়ম-দলাদলির প্রভাব শিক্ষা-গবেষণায়’

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক নানা অনিয়ম ও শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলির প্রভাব শেষ পর্যন্ত শিক্ষা ও গবেষণায় পড়ছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি এখন আর কারও অজানা নয়। আবার শিক্ষকদের মধ্যেও দলাদলি প্রকট হয়েছে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় ডুবছে। প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ও গবেষণায়। কিছু শিক্ষক ক্লাসরুম ছেড়ে রাজনীতিতে বেশি সময় ব্যয় করছেন। সর্বশেষ শিক্ষক সমিতি আন্দোলন করছে। ফলে একটি তদারক কমিটি গঠন করে উপাচার্য ও শিক্ষক সমিতির সঙ্গে বসে সরকারের উচিত বিষয়গুলো সুরাহা করা।