বিদেশ থেকে লাশ হয়ে আসা নারীদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী: রামরুর গবেষণা

‘ডেথ অব উইমেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে
ছবি প্রথম আলো

বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নারীরা লাশ হয়ে ফেরত আসছেন। লাশ দেশে আসার পর মৃত শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলেও দেশে পুনরায় ময়নাতদন্তও করা হচ্ছে না। নারী শ্রমিক পাঠানোর যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, সেখানে শ্রমিকের মৃত্যু হলে সংশ্লিষ্ট দেশের মালিককে দায় নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আলোচকেরা এসব কথা বলেছেন।

২০১৭ সাল থেকে দেশে আসা ৫৫৮ নারী শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ ও করণীয় বিষয়ে ‘ডেথ অব উইমেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শীর্ষক এই গবেষণা করেছে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে এ গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

আলোচকেরা বলেছেন, শ্রমিক বিশেষ করে অভিবাসী নারী শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি এখনো তেমন আলোচনায় আসেনি। বিষয়টিকে অভিবাসন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ মৃত শ্রমিকের যে মৃত্যু সনদ পাঠাচ্ছে, তা দায়সারাভাবে পাঠাচ্ছে। তাতে মৃত্যুর কারণও স্পষ্ট করা হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক ফোরামের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে মৃত্যু সনদের একটি ফরমেট তৈরিরও উদ্যোগ নিতে হবে। নারী শ্রমিককে বিদেশ যাওয়ার আগে দেশে যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হচ্ছে, তা আরও যুগোপযোগী করতে হবে।
বিমানবন্দরে লাশ আসার পর লাশ আনতে যাওয়া আত্মীয়দের বসার জায়গা করার পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন আলোচকেরা।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের লাশ দেশে ফেরার পর ময়নাতদন্ত করলে তা শ্রম বাজারে প্রভাব ফেলবে- এমন ভয়ের কোনো কারণ নেই। নারী শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিতেই কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার দায় সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকের তা উল্লেখ করতে হবে।

কামাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, দরিদ্র এবং প্রায় অশিক্ষিত পরিবার থেকে নারী শ্রমিকেরা বিদেশে কাজের জন্য যাচ্ছেন। আর মারা যাওয়ার পর লাশের সঙ্গে পাঠানো মৃত্যু সনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লিখে পাঠাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশ। এটি খুবই আশ্চর্যের বিষয়। এর দায় নিতে হবে রাষ্ট্রসহ সবাইকে।

রামরুর গবেষণার তথ্য

অনুষ্ঠানে গবেষণার সারাংশ তুলে ধরেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী। গবেষণার বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম।
তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে পাওয়া নারী অভিবাসীর মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গবেষণায় মৃত নারী শ্রমিকের ১০০টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আর গবেষণাটি করা হয়েছে নারী শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে তথ্য জানার পাশাপাশি অভিবাসন খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য। এতে কারও ওপর দায় চাপানো হয়নি, তবে সংশ্লিষ্টদের করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।

গবেষণায় ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে আসা ৬৯১ নারী অভিবাসীর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে যাওয়া নারী শ্রমিক ছিলেন ৫৫৮ জন। গবেষণার তথ্য বলছে, মৃত্যু সনদে উল্লেখ করা মৃত্যুর কারণ অনুযায়ী ৬৯ শতাংশ শ্রমিকের স্বাভাবিক (বিভিন্ন রোগসহ) এবং ৩১ শতাংশ নারী শ্রমিকের অস্বাভাবিক (দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা) মৃত্যু হয়েছে।

গবেষণায় ১০০টি পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, যাদের লাশ দেশে এসেছে তাদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ১০ শতাংশের বিদেশে যাওয়ার আগেই কোনো না কোনো ক্রনিক অসুখ ছিল। পরিবারের সদস্যরা স্বজনের মৃত্যুর তথ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জানতে পেরেছেন ওই দেশে কর্মরত অন্য বাংলাদেশি শ্রমিক বা অন্যদের কাছ থেকে। দূতাবাস থেকে খবরটি পেয়েছেন সবার শেষে। লাশ পাওয়া পরিবারগুলোর ৪৮ শতাংশই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

আরও পড়ুন

আলোচনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা এর আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সাবেক সচিব এবং মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়ে দ্রুত তথ্য পাওয়ার জন্য বিশেষ অ্যাপ তৈরির সুপারিশ করেন।

রামরুর গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে সেলিম রেজা বলেন, লাশ হয়ে ফেরত আসা নারী শ্রমিকদের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী হিসেবে কাজে গিয়েছিলেন। এই পেশায় নারীদের না পাঠিয়ে অন্য পেশার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ আর কত দিন ‘কাজের বুয়া’ বিদেশে পাঠাবে তাও ভাবার সময় এসেছে। যাওয়ার আগে নারী শ্রমিকদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাতে ফিলিপাইনের মতো আত্মরক্ষার কৌশল শেখানোরও সময় এসেছে।

সেলিম রেজা বলেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে আইনে অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে। নারী শ্রমিকের সার্বিক সুরক্ষা এবং মারা যাওয়ার পর পরিবারের কাছে ক্ষতিপূরণ পৌঁছে দেওয়াসহ বোর্ডকে সব কাজের দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের পরিবারকে বিভিন্ন সেবা পেতে যাতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক যে মৃত্যুই হোক সংশ্লিষ্ট দেশ প্রতিটি মৃত্যুর ময়নাতদন্ত করবে সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে শ্রমিকের মৃত্যু সনদে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ লিখে পাঠানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে, এটা দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করে শ্রমিকের মৃত্যু সনদের ফরম্যাট তৈরি করতে হবে। শ্রমিকের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা মুঠোফোনে যাতে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারেন তাও নিশ্চিত করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, নারী শ্রমিকের লাশ দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরেই সুরতহাল করার জন্য একজন নারী পুলিশ নিয়োগ দিতে হবে। সুরতহাল প্রতিবেদন এবং পরিবারের সদস্যদের মনে কোনো সন্দেহ থাকলে তা ময়নাতদন্ত করতে হবে। তিনি বলেন, এসব তথ্য অন্য দেশ মানতে বাধ্য নয়। তবে তথ্য আমলে নেবে। তাই এতে শ্রম বাজারে প্রভাব প্রভাব পড়বে মনে করে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

শামীম হায়দার পাটোয়ারী কল সেন্টারের মাধ্যমে নারী কর্মীদের ফোন করে তিনি ভালো আছেন কি না, তা জানার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন। এই সংসদ সদস্য বলেন, কোনো শ্রমিকের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে তখনই শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে আনছে ভারত সরকার। এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকারকে নিতে হবে। শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে আলাদা কনভেনশন বা সনদ প্রণয়নে আন্তর্জাতিক ফোরাম পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি রামরুর গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য এবং সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে যে সুপারিশগুলো পাওয়া গেল, তা জাতীয় সংসদে উত্থাপন করার উদ্যোগ নেবেন বলেও আশ্বাস দেন।

‘ডেথ অব উইমেন মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবে
ছবি: প্রথম আলো

সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশে লোক পাঠানোর প্রয়োজন আছে। তবে শ্রমিক পাঠানোর চুক্তিতে দুর্বলতা আছে। বিদেশে যে নারী শ্রমিকেরা মারা যাচ্ছেন সবাই নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছেন, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে মৃত্যুর আগে কোন পরিবেশে কাজ করেছেন, শ্রমিকের হাতে মুঠোফোন ছিল কি না, অভিযোগ করতে পেরেছিলেন কি না এসব দেখতে হবে। বিদেশ যাওয়ার আগে শ্রমিককে ইনস্যুরেন্সের আওতায় আনা গেলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির প্রয়োজনেই শ্রমিকের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, রামরুর গবেষণা নির্মোহ এবং এটাকে পক্ষপাতদুষ্ট বা উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেক সময় মনে করা হচ্ছে মৃত্যুর কারণকে চ্যালেঞ্জ করা হলে তা শ্রম বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সত্যকে তো আর বেশি দিন চেপে রাখা সম্ভব না। নিজেদের গবেষণার প্রয়োজনে হলেও পরিবারের সম্মতি নিয়ে মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ থাকা ৫ থেকে ১০ শতাংশ লাশের ময়নাতদন্ত করা প্রয়োজন। মৃত শ্রমিকের পরিবারকে কল্যাণ বোর্ড থেকে যে তিন লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার সুপারিশ করেন তিনি। এছাড়া যে কর্মী বিদেশ যাচ্ছে ওই কর্মী ও কর্মীর পরিবারকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।