২৭% মামলাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে

  • চার বছরে ৩৫৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা।

  • চার বছরে গ্রেপ্তার ৮৪ সাংবাদিক।

  • বেশির ভাগ মামলার বাদী ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।

প্রতীকী ছবি

দুর্নীতি–সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের জেরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গত বছরের জুনে গ্রেপ্তার হন রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহী। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের ছয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একই আইনে আরেকটি মামলা করা হয়। দুই মামলারই বাদী সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়ে।

মানবাধিকার ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুযায়ী, দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। আর বেশির ভাগ মামলা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। সিজিএস ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ১ হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। তাতে উঠে এসেছে, এসব মামলার মধ্যে ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৫৫ জন সাংবাদিককে।

মানবাধিকার ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুযায়ী, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার করে সাংবাদিকদের হেনস্তা করা হচ্ছে। আইনটি অবিলম্বে হয় শোধরানো দরকার অথবা একবারে বাতিল করা দরকার।
ফারুখ ফয়সল, আর্টিকেল-১৯-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক

সিজিএস বিশ্লেষণ বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। আসামি হওয়া রাজনীতিকের সংখ্যা ৪০৩ জন (৩১ শতাংশ)। এর পরেই আছেন সাংবাদিক (৩৫৫ জন)। তারপর আছেন শিক্ষার্থী (১১৮ জন)।

আর এক দিন পর, ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সকল প্রকার মানবাধিকারের চালিকা শক্তি’। এবার দিবসটি এমন এক সময় পালিত হচ্ছে, যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে দেশের সংবাদকর্মী ও মুক্তমত প্রকাশকারী ব্যক্তিরা চাপের মধ্যে আছেন।

আরও পড়ুন

মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন আর্টিকেল-১৯ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে আসছে। সংগঠনটি ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত দায়ের হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা ৫৮৪টি মামলা বিশ্লেষণ করেছে। তাতে দেখা যায়, এর মধ্যে ১১৫টি মামলায় ২২৯ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়েছে ১৩টি মামলা।

গত জুনে রাঙামাটির সাংবাদিক ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন রাঙামাটি জেলা মহিলা লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগমের মেয়ে নাজনীন আনোয়ার। তিনি জেলা প্রশাসকের বাংলোর পার্ক ইজারা নিয়ে সেটা আরেকজনের কাছে ভাড়া দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
আইনটি হওয়ার আগে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মতো এই আইনেরও অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক নেতা
আরও পড়ুন

সেখানে রেস্তোরাঁয় মাদক সেবনের অভিযোগ ছিল। জেলা প্রশাসনের ইজারা বাতিল করাকে কেন্দ্র করে বিরোধ বাধে। এ নিয়ে প্রতিবেদন করায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি গ্রেপ্তারের এক দিন পর আদালতের আদেশে জামিনে মুক্ত হন। সাংবাদিক ফজলে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, এখন তিনি অনেক ক্ষেত্রে সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতে ভয় পান।

এ ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করায় গত সেপ্টেম্বরে আরও ছয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন সাবেক সংসদ সদস্যের মেয়ে নাজনীন। দ্বিতীয় মামলার আসামিদের একজন দীপ্ত টেলিভিশনের ঢাকার বিশেষ প্রতিনিধি বায়েজিদ আহমেদ। তাঁর মতে, তাঁরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বলেছে, যেসব ধারা সংশোধন করা দরকার, সেটি তারা করবে। আইনটি সংশোধনে সরকারের কোনো সহায়তার প্রয়োজন হলে মানবাধিকার কমিশন সেটি করবে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

উদ্বেগ আমলে নেওয়া হয়নি

সাড়ে চার বছর আগে, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সরকার। এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই আশঙ্কা ও উদ্বেগ জানিয়েছিল মতপ্রকাশ ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো। এই আইনের অপপ্রয়োগ নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগের কথা জানিয়ে আসছিল সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন। তারা আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধনের দাবি করলেও সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

পেশাগত কারণে তিনি বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হয়েছেন, এর আগে ফৌজদারি মামলার আসামি হননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আসামি হবেন, সেটা ভাবতে পারেননি।
আবু তৈয়ব, খুলনার সাংবাদিক
আরও পড়ুন

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইনটি হওয়ার আগে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মতো এই আইনেরও অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সেই অভিযোগ যৌক্তিক কি না, সেটি প্রেস কাউন্সিলে পাঠানো উচিত। তখন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইনের অপপ্রয়োগ হতো না। তিনি বলেন, শুধু সাংবাদিক নন, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও বলছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও এই আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিভিন্ন সময় বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হবে না। প্রয়োজনে এই আইনের সংশোধনও করার কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী। যদিও আগে আটক করে পরে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনাও ঘটেছে।

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভারে কর্মরত) শামসুজ্জামানকে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার ২০ ঘণ্টা আগে (গত ২৮ মার্চ দিবাগত ভোর চারটায়) সাভারের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়। এ মামলা গ্রেপ্তার দেখিয়ে ২৯ মার্চ শামসুজ্জামানকে কারাগারে পাঠানো হয়। শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়ার পৌনে দুই ঘণ্টা আগে তেজগাঁও থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরও একটি মামলা হয়। এ দুই মামলায় জামিনে আছেন তিনি।

রমনা থানার মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পান। গত ২ এপ্রিল বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সরকার বলেছে, যেসব ধারা সংশোধন করা দরকার, সেটি তারা করবে। আইনটি সংশোধনে সরকারের কোনো সহায়তার প্রয়োজন হলে মানবাধিকার কমিশন সেটি করবে। মানুষের জন্য আইনটি যেন ক্ষতিকর না হয়, সে বিষয়েও পরামর্শ দেবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

মামলার বাদী কারা

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার মধ্যে ৩৫৩টি মামলার তথ্য-উপাত্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করেছে সংগঠনটি। সেসব মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫৫টি মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ৩০টির বাদী আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একজন ভুক্তভোগী খুলনার সাংবাদিক আবু তৈয়ব (৬৩)। তিনি বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির খুলনা ব্যুরোর প্রধান। ফেসবুকে দুর্নীতির ভুয়া তথ্য প্রকাশ করার অভিযোগ এনে তাঁর বিরুদ্ধে ২০২১ সালের এপ্রিলে মামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা ও খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এক মাস কারাগারে ছিলেন আবু তৈয়ব। পরে জামিনে মুক্তি পান।

আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, পেশাগত কারণে তিনি বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হয়েছেন, এর আগে ফৌজদারি মামলার আসামি হননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আসামি হবেন, সেটা ভাবতে পারেননি।

আবু তৈয়বের মতো অনেক সাংবাদিক এই আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার প্রথম চার বছরে (সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২২) মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ। তাতে বলা হয়, এই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয় ৮৪ জন সাংবাদিককে।

আর্টিকেল-১৯-এর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল প্রথম আলোকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার করে সাংবাদিকদের হেনস্তা করা হচ্ছে। আইনটি অবিলম্বে হয় শোধরানো দরকার অথবা একবারে বাতিল করা দরকার।