এক চাকরিজীবনে বহু অনিয়মের সঙ্গী

মো. সহিদ হোসেন সেলিমছবি: সংগৃহীত

সরকারের অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাই তাঁর চাকরি অবৈধ। কর্মজীবনে তিনি নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বলে একাধিক তদন্তে উঠে আসে। একবার তাঁর পদাবনতিও হয়। এত কিছুর পরও সরকারের পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) চাকরি যায়নি মো. সহিদ হোসেন সেলিমের।

পিডিবিএফে সহিদ হোসেনের সর্বশেষ পদ মাঠ পরিচালন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান। তাঁর ভাষ্য, তিনি ২ মে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে পিডিবিএফের ঊর্ধ্বতন কারও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সহিদ হোসেন এখনো নিয়মিত অফিসে যাচ্ছেন। সরকারি গাড়িও ব্যবহার করছেন।

পিডিবিএফের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও একবার পদাবনতি ছাড়া সহিদ হোসেনের কিছু হয়নি। উল্টো তিনি শেষ সময়ে এসে তাঁর চাকরির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ জন্য তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কমিয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তিনি তড়িঘড়ি করে ইস্তফার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এখন পিডিবিএফের বর্তমান কর্তৃপক্ষ তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে সহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর পেছনে লেগেছে।

পল্লি অঞ্চলের দারিদ্র্য দূর করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে পিডিবিএফ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন একটি স্বশাসিত নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান।

অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ

২০ বছর আগে পিডিবিএফে বিশেষ নিরীক্ষা করেছিল অডিট অধিদপ্তর। ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০০৪ সালের ৩০ জুন সময়কালের এই নিরীক্ষার প্রতিবেদনে পিডিবিএফে অনিয়মের মাধ্যমে সহিদ হোসেনের নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।

নিরীক্ষার সময় সহিদ হোসেন আইটি শাখার ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত ছিলেন। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির চাহিদা অনুযায়ী, কম্পিউটারের ওপর ‘অ্যাডভান্স ডিগ্রি’ না থাকায় সহিদ হোসেন এই পদে আবেদন করারই যোগ্য ছিলেন না। কিসের ভিত্তিতে তাঁর নিয়োগ ও বেতন নির্ধারণ করা হলো, সেসব নথিপত্রে পাওয়া যায়নি। নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহিদ হোসেন অভিজ্ঞতার যেসব বিবরণ দিয়েছেন, সেগুলোর পক্ষেও কোনো প্রমাণ নথিতে পাওয়া যায়নি। তাঁর আগের প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্রও নথিভুক্ত ছিল না।

সহিদ হোসেনের বিধিবহির্ভূত নিয়োগ বাতিল, তাঁর চাকরিচ্যুতি, বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া সব টাকা আদায় ও নিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।

পিডিবিএফের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে নবম জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৯তম বৈঠকে আলোচনা হয়। ২০১০ সালের ২২ জুন অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মন্তব্যগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করে কমিটি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে তা কমিটিকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর বেশ কয়েক বছর চলে গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সহিদ হোসেনের বিষয়টি উল্লেখ করে ২০১৭ সালের মার্চে পিডিবিএফের এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি আমিরুল ইসলাম স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে চিঠি দেন। এতে সরকারি হিসাব–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। ব্যবস্থার বিষয়ে অডিট অধিদপ্তর থেকেও একাধিকবার পিডিবিএফকে চিঠি দেওয়া হয়।

২০২১ সালে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয় পিডিবিএফের ওপর একটি বিশেষ নিরীক্ষা করে। ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০—এই তিন অর্থবছরের ওপর করা নিরীক্ষায়ও সহিদ হোসেনের বিধিবহির্ভূত নিয়োগের বিষয়ে আপত্তি ওঠে। এতে বলা হয়, সরকারি হিসাব–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির নির্দেশ লঙ্ঘন করে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

একাধিক তদন্তে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ

পিডিবিএফে হওয়া অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ একাধিক তদন্ত কমিটি করে। কমিটির প্রতিবেদনে বেশ কিছু আর্থিক অনিয়ম প্রমাণিত হয়। এমন একাধিক অনিয়মে সহিদ হোসেনের নাম উঠে আসে।

একটি তদন্ত অনুযায়ী, পিডিবিএফের সৌরশক্তি প্রকল্পের পরিচালক থাকার সময় সহিদ হোসেন সোলার সামগ্রী সরবরাহ-স্থাপনে প্রাপ্ত অর্থের বিপরীতে ৫ শতাংশ ছাড় (ডিসকাউন্ট) অনুমোদন করেন। এটা তাঁর আর্থিক এখতিয়ারের বাইরে ছিল। এই ব্যয়ের বিপরীতে কোনো বিল পাওয়া যায়নি। এই ব্যয়ের কোনো বাজেট অনুমোদনও ছিল না।

তদন্তে বলা হয়, সহিদ হোসেন ও সংস্থার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মদন মোহন সাহা সৌরশক্তি প্রকল্প থেকে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে এই অর্থের সিংহভাগ আত্মসাৎ করেছেন। সহিদ হোসেন ভুয়া ও কাগুজে কোম্পানি সলিটন ইলেকট্রনিকসের কাছ থেকে মালামাল কেনার জন্য ২০ লাখ ৪১ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। এই ঘুষ সহিদ হোসেন তাঁর ভাগনে সাইফুল ইসলামের নামে চেকের মাধ্যমে নেন।

সাইফুল বর্তমানে পিডিবিএফের বগুড়ার শেরপুর কার্যালয়ের সহকারী হিসাব কর্মকর্তা।

সিএজি কার্যালয়ের করা ২০২১ সালের বিশেষ নিরীক্ষায় দেখা যায়, পিডিবিএফের সৌরশক্তি প্রকল্পে নতুন মালামালের পরিবর্তে সংস্থার পুরোনো ও নষ্ট মালামাল সরবরাহ করা হয়। এ বাবদ ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। এই টাকা সংস্থার তৎকালীন অতিরিক্ত পরিচালক সহিদ হোসেন ও তাঁর ভাগনে সাইফুলের ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়।

আপিল করা হয়নি

পিডিবিএফ আইন অনুযায়ী, সংস্থার তহবিলের সব অর্থ বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের (পিডিবিএফ) নামে খোলা হিসাবে জমা রাখতে হবে। ২০১৮ সালে আইন লঙ্ঘন করে তফসিলি ব্যাংকের পরিবর্তে পাঁচটি লিজিং কোম্পানিতে পিডিবিএফের ৪৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা স্থায়ী জামানত হিসেবে জমা রাখা হয়। দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও পিডিবিএফ এই অর্থ ফেরত আনতে পারেনি।

পিডিবিএফ সূত্রে জানা যায়, যেসব লিজিং কোম্পানিতে টাকা রাখা হয়, তার মধ্যে আলোচিত পি কে হালদারের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং রয়েছে।

লিজিং কোম্পানিতে পিডিবিএফের টাকা রাখার ঘটনায় সহিদ হোসেনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত সেপ্টেম্বরে মামলাটি খারিজ করেন আদালত। ফলে আসামিরা অব্যাহতি পান। তবে পিডিবিএফের বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি।

পদাবনতি

নানা অভিযোগ নিয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের একটি তদন্তের ভিত্তিতে সহিদ হোসেনকে ২০১৯ সালে সংস্থার অতিরিক্ত পরিচালক থেকে পদাবনতি দিয়ে যুগ্ম পরিচালক করা হয়।

পিডিবিএফের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সহিদ হোসেনকে পদাবনতি দেওয়া হলেও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্তৃপক্ষ তাঁকে গত বছরের জানুয়ারিতে মাঠ পরিচালন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেয়। এই বিভাগ মাঠপর্যায়ে পিডিবিএফের মূল কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই বিভাগের প্রধানের পদের নাম পরিচালক। পদাবনতি পাওয়া একজন যুগ্ম পরিচালককে পরিচালক পদে অতিরিক্ত বা চলতি দায়িত্ব দিলে সমালোচনা হবে, তাই সহিদ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান নামে পদায়ন করা হয়। অথচ তাঁর নিয়োগই অবৈধ। সে হিসেবে তাঁর তো চাকরিই থাকার কথা না।

সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পিডিবিএফের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা করা হয়। তালিকার ১ নম্বর নাম ছিল সহিদ হোসেনের। সেখানে তাঁর জন্মতারিখ উল্লেখ ছিল ১৯৬৫ সালের ৪ মে। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রেও একই জন্মসাল ও তারিখ আছে। ফাউন্ডেশনের নিয়ম অনুসারে, সে হিসাবে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ৩ মে। কিন্তু মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেটে তাঁর জন্মতারিখ ১৯৬৪ সালের ৪ মে।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবিএফের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়াতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কমান সহিদ হোসেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। পরে সহিদ হোসেন চলতি মাসের শুরুর দিকে চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু তারপরও তিনি নিয়মিত অফিসে আসছেন। সরকারি গাড়িও ব্যবহার করছেন। এখন কর্তৃপক্ষ তাঁকে এক বছরের জন্য প্রশাসন শাখার প্রধান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছে।

১৪ মে দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে পিডিবিএফের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে সহিদ হোসেনকে অফিস কক্ষে পাওয়া যায়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই। একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমার পেছনে লেগেছে।’

এ বিষয়ে কথা বলতে একই দিন পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ মউদুদউর রশীদ সফদারের কার্যালয়ে গেলে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান, তিনি কক্ষে নেই। পরে তাঁকে ফোন করা হয়। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।

পিডিবিএফের বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারপারসন এবং পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সিনিয়র সচিব মোসাম্মৎ শাহানারা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, এত বিস্তৃত অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। নথিপত্র যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন