‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ স্লোগানটি কীভাবে এল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যে কয়েকটি স্লোগান আন্দোলনকারীদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও শীর্ষ ছাত্রনেতাদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ স্লোগান ব্যবহার করেছেন।
জুলাইয়ে তরুণেরা নিজেরা যেমন স্লোগান তৈরি করেছেন, তেমনি ব্যবহার করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম থেকে জন্ম নেওয়া স্লোগানও। তার একটি ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’।
এ স্লোগানের পটভূমি কিউবার স্বাধীনতার সংগ্রাম। ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কিউবার সংবাদমাধ্যম হাভানা টাইমসে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জানা যায়, স্লোগানটির জন্ম ১৮৬৮ সালে স্পেনের উপনিবেশ থেকে কিউবার স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরুর দিকে। তখন স্লোগানটি ছিল ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’।
এরপর কিউবার কাউতো নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। ১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবে পতন ঘটে কিউবার মার্কিন মদদপুষ্ট বাতিস্তা সরকারের। যদিও শান্তি ফেরেনি। কিউবায় ঘটতে থাকে একের পর অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা। ১৯৬০ সালের মার্চে কিউবার রাজধানী হাভানার সমুদ্রবন্দরে একটি ফরাসি জাহাজে বোমা হামলা হয়। সে হামলায় মারা যান ১০০ জন।
ওই বছরের ৬ মার্চ নিহত ব্যক্তিদের শেষকৃত্যে সহযোদ্ধাদের লাশের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফিদেলের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে শপথ নেন ‘স্বদেশভূমি অথবা মৃত্যু’ স্লোগান দিয়ে।
হাভানা টাইমসের লেখাটিতে ফিদেলের সেদিনের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ফিদেল বলেন, ‘আমাদের বিপ্লব শক্তিশালী, আমাদের বিপ্লব অজেয়। কারণ, আমাদের জনগণ বিপ্লব রক্ষায় জীবন দিতে দ্বিধা করবে না।’
ফিদেল সেদিন আরও বলেন, ‘আমরা যখন স্বৈরাচার বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, তখন আমরা ছিলাম ১২ জনের একটা দল। কেউ বিশ্বাস করেনি আমরা বাতিস্তার পতন ঘটাতে পারব। আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমরা পারব। আজকেও আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনো আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র আমরা রুখে দিতে পারব। কারণ, আমাদের সামনে একটাই পথ, “মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু”।’
ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কিউবা শাসন করেন। নিজের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকলে ২০০৮ সালে তিনি ভাই রাউল কাস্ত্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে মারা যান ফিদেল।
রাউল অবসর নিলে ২০১৯ থেকে কিউবার বিপ্লবের অন্যতম নেতা মিগুয়েল দিয়াজ কেনেল কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন।
ফিদেলের সেই শপথের অর্ধযুগ পর জাতিসংঘের অধিবেশনে স্লোগানটি ফিরে আসে কিউবার বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক আর্নেস্তো চে গুয়েভারার কণ্ঠে। ঘটনাটি ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের। পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরে জাতিসংঘে বক্তব্য দেন চে। তিনি ভাষণ শেষ করেন ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ স্লোগান দিয়ে।
এমন একটা সময়ে চে গুয়েভারা স্লোগানটি ফিরিয়ে আনেন, যখন লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা, এশিয়াসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম জোরদার হচ্ছিল। তৃতীয় বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলো ইউরোপীয় উপনিবেশ থেকে একে একে স্বাধীন হচ্ছিল।
মেক্সিকোতে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল চে গুয়েভারার। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর চে তখন ফিদেলের দলে যোগ দেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পর ফিদেলের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকারে একাধারে শিল্পমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন চে। ১৯৬৫ সালে হঠাৎ জনসমক্ষ থেকে আড়ালে চলে যান তিনি। যোগ দেন কঙ্গোর বিপ্লবীদের সঙ্গে।
পরে বলিভিয়ার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত গেরিলা দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে আহত হন চে। সে অবস্থায় বলিভিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন তিনি। ১৯৬৭ সালে ৮ অক্টোবর চে গুয়েভারাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ফিদেল ও চে যে স্লোগান দিয়েছিলেন, তা এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা স্লোগানের মধ্যে রয়েছে ‘চেয়ে দেখো এই চোখের আগুন, এই ফাল্গুনে হব দ্বিগুণ’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’।
নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের অনেকে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটিও ব্যবহার করছেন, যেটি জনপ্রিয় হয়েছিল ভারতের বামপন্থীদের মাধ্যমে।
জানতে চাইলে লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, কিউবায় ‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’ স্লোগানের জন্ম হলেও এটি লাতিন আমেরিকা ও মধ্য আফ্রিকার অনেক দেশে জনপ্রিয় হয়।
‘ফিদেলরা যখন এ স্লোগান দিচ্ছিলেন, তখন তাঁরা আমাদের তরুণদের সমবয়সী বা বছর দুয়েকের বড় হবেন। কিন্তু তাঁরা ছিলেন আমূল পরিবর্তনবাদী। তাঁরা স্লোগানটিকে মিন (যা বলতেন সে অনুযায়ী কাজ করতেন) করতেন। ‘‘মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু” বলে তাঁরা আমলাতন্ত্রের ভেতর ঢুকে যাননি। তাঁরা নতুন ও জনমুখী প্রশাসনিক কাঠামো গড়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন’, বলেন আলতাফ পারভেজ।