জুলাই ফাউন্ডেশন পরিচালনায় টাকা নেই, অনিশ্চয়তায় কর্মীদের বেতন

১০০ কোটি টাকা অনুদানে যাত্রা শুরু করেছিল জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, নানা অনুদানে তহবিল বেড়েছিল আরও। কিন্তু এক বছরের মাথায় অর্থসংকটে এখন ফাউন্ডেশনের কর্মীদের বেতন দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে।

ফাউন্ডেশনের আবর্তক বা পরিচালন ব্যয় খাতে টাকা না থাকায় এখানে কর্মরত ব্যক্তিরা নভেম্বর মাস থেকে বেতন-ভাতা পাবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিবের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাবর ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কামাল আকবর আবর্তক ব্যয় খাতে ৫ কোট টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন; কিন্তু এখনো সেই চিঠির কোনো জবাব পাননি বলে জানিয়েছেন তিনি।

বর্তমানে সিইওসহ ফাউন্ডেশনে কর্মরত আছেন ৪৪ জন। রাজধানীর শাহবাগে ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ মাসে খরচ হচ্ছে দেড় লাখ টাকা। ফাউন্ডেশনের আবর্তক ব্যয় খাতের মধ্যে বেতন, ভাতা, প্রশাসনিক ব্যয়, ফাউন্ডেশনের অফিস ভাড়া, যানবাহন কেনা, ভাড়া করা, মেরামত, জ্বালানি, ভ্রমণ ব্যয়, আসবাব কেনাসহ আনুষাঙ্গিক খরচ রয়েছে।

আবর্তক ব্যয় খাতে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ফাউন্ডেশন। সেই চিঠির কোনো জবাব আসেনি এখনো। ফলে ফাউন্ডেশনের কর্মীদের নভেম্বরের বেতন পড়েছে অনিশ্চয়তায়।

কামাল আকবর প্রথম আলোকে বলেন, লাশ দাফনসহ বিভিন্ন দাতব্য খাত আছে সরকারের। তেমন কোনো খাত থেকে বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ১০০ কোটি টাকা অনুদান দেন। ওই দিন রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারকে দেখাশোনার যে দায়িত্ব সরকার নিয়েছে, তা এই ফাউন্ডেশন থেকে পরিচালিত হবে। একই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাসহ অন্যান্য সহযোগিতা নিশ্চিত করবে এই ফাউন্ডেশন।

এদিকে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সার্বিক দেখভালের জন্য গঠিত ফাউন্ডেশন পরিচালনার টাকা না থাকলেও সরকার জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের কবর সংরক্ষণ, স্মৃতিস্তম্ভ বানানোসহ অন্যান্য খাতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে সমালোচনা করছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

জুলাই শহীদ মীর মাহমুদুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে প্রথমে ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক, পরে সিইও করা হয়। গত ৮ মে সিইও পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তিনি বর্তমানে ফাউন্ডেশনের গভর্নিং বডির (পরিচালনা পর্ষদ) নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রধান উপদেষ্টাসহ (সভাপতি) ছয় সদস্যবিশিষ্ট এ বোর্ডে সরকারের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম, শারমীন এস মুরশিদ এবং আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মীর মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের বিষয়টি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া জরুরি। তারপর শহীদদের স্মৃতি রক্ষাসহ অন্যান্য কাজে হাত দিতে হবে।

ফাউন্ডেশনে সিইওসহ কর্মরত এখন ৪৪ জন। শাহবাগে ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের কার্যালয়ের ভাড়া বাবদ মাসে খরচ হচ্ছে ৩১ লাখ টাকা। আবর্তক ব্যয় খাতের মধ্যে বেতন-ভাতা ছাড়াও রয়েছে প্রশাসনিক ব্যয়, আসবাব কেনা ইত্যাদি।

ফাউন্ডেশন চলছে যেভাবে

অক্টোবর মাস পর্যন্ত ফাউন্ডেশনে কর্মরতদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ কীভাবে চলেছে, এ প্রশ্নের উত্তরে ফাউন্ডেশনের সিইও আকবর কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৮ মাসের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ বেতন বাবদ ১ কোটি টাকা, ভাতা বাবদ ২৫ লাখ টাকা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ২০ লাখ টাকার সঙ্গে বিশেষ অনুদানের ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকাসহ ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল। ওই বরাদ্দ থেকেই ফাউন্ডেশন এত দিন চলেছে। তবে অক্টোবর মাসের পর চলা আর সম্ভব না।

সরকার অনুমোদিত অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবামূলক, স্বাধীন এই বেসরকারি ফাউন্ডেশনে শুধু কর্মীদের বেতন–ভাতা নয়, সরকার এবং অন্যান্য জায়গা থেকে অনুদান পাওয়া তহবিলের টাকাও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম চলবে কি না, সে শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন

১০০ কোটি টাকা অনুদানে ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করার পর ফাউন্ডেশনের তহবিলে ৫ কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৫ কোটি টাকা দিয়েছিলেন নাম প্রকাশ না করা এক নারী। ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে এবং আরও কিছু জায়গা থেকে অনুদান পাওয়া যায়। সব মিলে এই তহবিলের আকার দাঁড়ায় ১১৯ কোটি টাকা। ১১৯ কোটি টাকার তহবিলে বর্তমানে আছে মাত্র প্রায় ৬ কোটি টাকা। তবে এই অর্থ ফাউন্ডেশনের কর্মীদের বেতন খাতে ব্যয় করার উপায় নেই।

প্রাথমিকভাবে প্রত্যেক শহীদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা, আহত প্রত্যেক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা এবং ক্ষতি অনুযায়ী জরুরি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা ছিল ফাউন্ডেশনের। বর্তমানে সরকারের প্রজ্ঞাপনভুক্ত শহীদের সংখ্যা ৮৩৪।

ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত শহীদ ৮২৯ জনের পরিবার এবং আহত ৬ হাজার ৮৬৫ জনকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন আর্থিক ও পুনর্বাসনে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া এখনো সম্ভব হয়নি ৮ হাজার ৪৪৬ জনকে। ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে ১১৩ কোটি ৯৯ লাখ ১৯ হাজার ১১৫ টাকা।

আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের বিষয়টি অবশ্যই অগ্রাধিকার পাওয়া জরুরি। তারপর শহীদদের স্মৃতি রক্ষাসহ অন্যান্য কাজে হাত দিতে হবে।
মীর মাহবুবুর রহমান, সদস্য, পরিচালনা পর্ষদ, জুলাই ফাউন্ডেশন

স্মৃতিস্তম্ভমুখী সরকার, সমালোচনা

গত ১৭ জুলাই চট্টগ্রামে ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম জানান, জুলাই শহীদদের স্মরণে দেশের ৮৬৪টি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। ১৪ জুলাই নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকায় ২১ জন শহীদের নামে নির্মিত দেশের প্রথম ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’টি উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ৫ উপদেষ্টা।

রাজধানীর ওসমানী উদ্যানেও জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে, যা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া অক্টোবর মাসের শুরুতে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন। এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি টাকা। তবে ওসমানী উদ্যানে আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্পসহ আবার স্থাপনা তৈরির বিষয়টিতে পরিবেশবাদীরা উদ্বেগ জানিয়েছেন।

শহীদদের কবর সংরক্ষণ, শহীদদের নামে বৃক্ষরোপণসহ অন্যান্য কাজও করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা দেড় দশকের আবাসস্থল গণভবনকে জুলাই স্মৃতি জাদুঘর করছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাদুঘরের রূপান্তর কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ১৬ জুলাই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে বাসভবনকে জাদুঘরে রূপান্তরে প্রায় ১১১ কোটি টাকার নির্মাণ ও সংস্কারকাজে ‘সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি’র নামে সরকার যেভাবে ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

আন্দোলনে গিয়ে আহত হওয়া ব্যক্তিরা এখনো চিকিৎসা-পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন। স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে যে খরচ, তা আগে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিদের জন্য ব্যয় করা জরুরি।
সাবরিনা আফরোজ, সদস্য, কার্যনির্বাহী কমিটি, জুলাই ফাউন্ডেশন

অন্যদিকে কয়েকবার ঘুরে সহায়তার টাকা না পেয়ে চলতি বছরের ৮ জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অফিস ভাঙচুর করেছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের কয়েকজন। গত ১৩ মে ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের সামনে ফাউন্ডেশনের সিইও এবং কোষাধ্যক্ষের অপসারণ দাবি করে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক সামসি আরা জামান ও সদস্য সাবরিনা আফরোজ দুজনই শহীদ পরিবারের সদস্য। শহীদ মাহামুদুর রহমানের (সৈকত) বড় বোন সাবরিনা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, স্মৃতিস্তম্ভ না বানালেও শহীদদের যাঁরা সম্মান দেওয়ার, তাঁরা ঠিকই সম্মান দেবেন। আন্দোলনে গিয়ে আহত হওয়া ব্যক্তিরা এখনো চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন, এটা সবার জন্যই লজ্জার। স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে যে খরচ, তা আগে শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত ব্যক্তিদের জন্য ব্যয় করা জরুরি।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর কার্যবণ্টন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
মশিউর রহমান, মহাপরিচালক, গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর

একই কাজে অধিদপ্তর ও ফাউন্ডেশন

গত ২৩ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন যাত্রা শুরু করে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর’। এ অধিদপ্তরের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা, ভাতা দেওয়া, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহায়তা, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণ, পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন কাজ করছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা হচ্ছে বলে জানান ফাউন্ডেশনের সিইও কামাল আকবর।

তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অধিদপ্তর কার্যবণ্টন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অধিদপ্তরের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।

ফাউন্ডেশন ও অধিদপ্তরের একই ধরনের কাজ করা, ফাউন্ডেশন পরিচালনার টাকা না থাকা নিয়ে মীর মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সংস্থায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কাজ ধীরগতির হয়। সেই তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফাউন্ডেশন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারে। এখন পর্যন্ত ফাউন্ডেশনই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিরা নিজেদের কথা বলতে পারেন। তাই ফাউন্ডেশনের গুরুত্ব বিবেচনায় শহীদ পরিবারের সদস্য এবং আহত ব্যক্তিরাই নিজেদের স্বার্থে ফাউন্ডেশনকে টিকিয়ে রাখবেন।

অর্থসংকট অচিরেই কেটে যাওয়ার আশা প্রকাশ করে মীর মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সামনে ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের সভা হওয়ার কথা, তাতে ফাউন্ডেশনের সমস্যার সমাধানে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে বলে আমি আশাবাদী।’

আরও পড়ুন