বর্ষার ওলটপালটে বাড়ল গরুর লাম্পি স্কিন রোগ

লাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এলএসডি নিয়ন্ত্রণে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হিমশিম খাচ্ছে। পর্যাপ্ত টিকা নেই।

সারা দেশে গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজের (এলএসডি) প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এতে আক্রান্ত প্রাণীর শরীরে গুটি ওঠে এবং তাতে ঘা হয়। অনেক গরু মারাও যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপর রয়েছে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগ। এলএসডি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

সারা বছরই এলএসডি রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। তবে দুই–তিন মাস ধরে এই রোগের প্রকোপ বেড়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৪ জুলাই ও তার আগের এক বছরে সারা দেশে এই রোগে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা ৮ হাজার ৪৯৪। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ হাজার ৩৩৭টি। এরপর ঢাকায় ১ হাজার ৯৪৭টি, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৮টি এবং রংপুর বিভাগে ৯৪১টি। সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে ৭৯টি।

ছোট গরুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা একটু কম থাকে। এ কারণে অল্প বয়সী গরু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে বেশি। তবে দেশি জাতের গরুর চেয়ে সংকর বা বিদেশি জাতের গরু বেশি মারা যাচ্ছে।
সার্জন সাজ্জাদ হোসেন, উপজেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আক্রান্ত পশুর মধ্যে বড় অংশই সাম্প্রতিক সময়ে আক্রান্ত। তা ছাড়া প্রাণিসম্পদ যে হিসাব প্রকাশ করেছে, বাস্তবে সেই সংখ্যা আরও বেশি।

সাম্প্রতিক সময়ে এই রোগের প্রকোপ কেন বাড়ল, জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ রেয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এলএসডি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা ছড়ায় মাছির কামড়ে। গ্রীষ্মকালে যখন মাছির উপদ্রব বাড়ে, তখন এই রোগও বাড়ে। এরপর যখন বর্ষা শুরু হয়, তখন এলএসডি চলে যায়।

কিন্তু এবার পর্যাপ্ত ভারী বৃষ্টি না থাকায় এই রোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে উল্লেখ করে রেয়াজুল হক বলেন, এবারের বর্ষা আদর্শ বর্ষা নয়। ফলে বর্ষার পানিতে মাছির প্রজননক্ষেত্র ধুয়ে চলে যাচ্ছে না বা নষ্ট হচ্ছে না। অল্প বৃষ্টির পর দুদিন রোদ হলে মাছি বেড়ে যাচ্ছে এবং এই রোগ ছড়াচ্ছে। তারপরও এই রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

অধিদপ্তরের অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, এলএসডি নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত টিকা নেই। এই রোগ প্রতিরোধ না করতে পারার এটি  আরেকটি কারণ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৪ জুলাই ও তার আগের এক বছরে সারা দেশে এই রোগে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা ৮ হাজার ৪৯৪। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ হাজার ৩৩৭টি। এরপর ঢাকায় ১ হাজার ৯৪৭টি, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৮টি এবং রংপুর বিভাগে ৯৪১টি। সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে ৭৯টি।

অল্প বয়সী গরু আক্রান্ত হচ্ছে বেশি

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার দক্ষিণ চনপাড়া গ্রামের মো. আবুল হাসানের চারটি গরু। তার মধ্যে একটি অল্প বয়সী বা পাঁচ মাসের, বাকিগুলো বড়। তাঁর সেই পাঁচ মাস বয়সী গরুটিই এলএসডিতে আক্রান্ত হয়েছে।

২৭ জুলাই পটিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে সেই বাছুর চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসেন আবুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আমার চারটি গরুর মধ্যে একটিই এই রোগে আক্রান্ত হয় দেড় মাস আগে। এক মাস ধরে এখানে চিকিৎসা করাচ্ছি। এখন অনেকটা ভালোর পথে।

আবুল হাসানের গরুসহ ২৭ জুলাই সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১০টির বেশি এলএসডি আক্রান্ত গরু পটিয়া ভেটেরিনারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। এসব গরু চিকিৎসার দায়িত্বে আছেন উপজেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন সাজ্জাদ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছোট গরুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা একটু কম থাকে। এ কারণে অল্প বয়সী গরু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে বেশি। তবে দেশি জাতের গরুর চেয়ে সংকর বা বিদেশি জাতের গরু বেশি মারা যাচ্ছে।

জানা গেছে, কোরবানির ঈদের পর থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে ৭১টি গরু এলএসডি আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তার মধ্যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মারা গেছে ৫৮টি গরু। মারা যাওয়া এসব গরুর মধ্যে অল্প বয়সী বেশি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বড় গরুর তুলনায় অল্প বয়সী গরুর টিকা কম দেওয়া থাকে। এ কারণে ছোট গরু বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এলএসডির টিকা উদ্ভাবনের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি টিকা উদ্ভাবনে সফল হলে আমাদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে।
অমলেন্দু ঘোষ, প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক

চট্টগ্রামে বেশি কেন

চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৩ থেকে ২৬ জুলাই চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ হাজার ৭৭৪টি গরু এলএসডিতে আক্রান্ত হয়েছে। এই চার দিনে প্রাণিসম্পদের চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে ২ হাজার ৩৪৬টি গরু। একই সময়ে ১৪ হাজার ৯৭৭টি গরুকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, কর্ণফুলী, পটিয়া, চন্দনাইশ—দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রতিটি বাড়িতে খামার। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা সেখানে অপ্রতুল।

এতে মশা–মাছি জন্মানোর সুযোগ বেশি। এ কারণে এসব এলাকার গরু এই রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বাইরের গরু বিশেষ করে কোরবানির সময় জীবাণু নিয়ে চট্টগ্রামে ঢুকেছে। রোগ বেড়ে যাওয়ার এটাও কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন

সংকটে দাম বাড়াল টিকার

বিশ্বে বিভিন্ন দেশে এলএসডি রোগ আগে থেকে থাকলেও বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৯ সালে। তারপর থেকে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ‘গোট পক্স’ নামের একটি টিকা ব্যবহার করে আসছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এই টিকা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ছাগল–ভেড়ার ‘গোট পক্স’ নামের রোগের জন্য উদ্ভাবন করেছিল।

এই টিকা এক ডোজ করে প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়। ৭ জুলাই এই টিকার দাম প্রতি বোতলে ২০ টাকা বাড়িয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। আগে যে টিকা প্রতি বোতল ছিল ৫৫ টাকা, তা এখন ৭৫ টাকা।

গোট পক্সের পাশাপাশি বিদেশ থেকে এলএসডি রোগের টিকা আমদানি করা হচ্ছে। গত বছরের ২৬ অক্টোবর ৫০ লাখ টিকা আমদানির জন্য কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। অন্য দিকে গত অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৩৯ লাখ গোট পক্স টিকা। সব মিলিয়ে এলএসডি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ৮৯ লাখ টিকার সংস্থান করে অধিদপ্তর।

অথচ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২০২১–২২ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা ৫ কোটি ৬৭ লাখের বেশি। তার মধ্যে গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪৭ লাখ। অর্থাৎ দেশে যে পরিমাণ গরু রয়েছে, তার অর্ধেক টিকার সংস্থানও সরকারের এই অধিদপ্তর করতে পারেনি।

প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অমলেন্দু ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) এলএসডির টিকা উদ্ভাবনের কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি টিকা উদ্ভাবনে সফল হলে আমাদের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে।

আরও পড়ুন

করণীয় কী

এলএসডির প্রকোপ বাড়লে ২৫ জুন একটি সতর্কতা বার্তা জারি করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চিঠি দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। সেখানে এই রোগ থেকে সুরক্ষায় কিছু করণীয় বিষয় তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়েছে, রোগের বিস্তার রোধে অসুস্থ গরুকে সুস্থ গরু থেকে আলাদা রাখতে হবে।

আক্রান্ত পশুর শরীর পাতলা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে যেন মশা–মাছি না বসে। সুস্থ গরুকে এলএসডি কিংবা গোট পক্স টিকা দিতে হবে। সুস্থ গরু পরিচর্যার পর অসুস্থ গরু পরিচর্যা করতে হবে এবং অসুস্থ গরু পরিচর্যার পর সব সময় পরিচর্যাকারীকে সাবান ব্যবহার করতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও খামারের পরিবেশ উন্নত করতে হবে।

তবে অধিদপ্তর টিকাদান, সতর্কতা, পরামর্শ দেওয়ার পরও গরুর এই রোগ কমছে না।