‘ঘরে পানি, এখানে দুই হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছি’
চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর বড়পাড়ার সব ঘরেই বুকসমান পানি। এ অবস্থায় এলাকার কয়েকটি পরিবার উপজেলার বাগিচাহাট এলাকায় সাময়িকভাবে বাসা ভাড়া নিয়েছে। বাগিচাহাট এখনো ডোবেনি। অস্থায়ীভাবে বাসা ভাড়া নেওয়া বড়পাড়ার বাসিন্দা আনোয়ার ইসলাম পানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বউ আর ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি ঘরের কিছু জিনিসপত্র নিতে এসেছি।’
হাশিমপুর বড়পাড়ার বাসিন্দা দানু মিয়াও বাগিচাহাট এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘরে পানি। এখানে দুই হাজার টাকায় একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। কোনোরকমে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বাবা ও স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে চলে আসি।’
হাশিমপুরের ভান্ডারিয়া এলাকায়ও দেখা গেল, ঘরে ঘরে পানি ঢুকেছে। সেখানকার মো. শাহ আলমের দোতলা পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন পাড়ার অনেক নারী ও শিশু। শহীদুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘ঘরে পানি। বউ–বাচ্চা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
পাহাড়ি এলাকায় হওয়া অত্যধিক বৃষ্টির পানি সমতলের দিকে দ্রুতবেগে নেমে আসায় চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকার কক্সবাজার মহাসড়কসহ বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বান্দরবানে রেকর্ড বৃষ্টি হওয়ার কারণে পাহাড়ি ঢল নেমেছে। সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় আজ বুধবারও চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক এবং চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সপ্তাহখানেক ধরে বান্দরবানে বৃষ্টি হচ্ছে। একইভাবে চট্টগ্রামেও বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। গত সোমবার দিবাগত রাত তিনটায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে সোমবার সন্ধ্যা থেকে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়। আজও দুই জেলার সঙ্গে চট্টগ্রামের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
রেকর্ড বৃষ্টিপাত
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে গত কয়েক দিনে চট্টগ্রামের পাশাপাশি বান্দরবানেও রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। দুই জেলায় মূলত বৃষ্টি শুরু হয় গত শুক্রবার। বান্দরবানে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার ৩৪২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা রেকর্ড। আর শনিবার থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বান্দরবানে মোট ৮৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বান্দরবান আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তা সনাতন কুমার মণ্ডল বলেন, বান্দরবানে এবার রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে সোমবার রেকর্ড ৩৪২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এক দিনে এত বৃষ্টি দেখা যায়নি। এ কারণে পাহাড়ি ঢল নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
এদিকে চট্টগ্রামে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। শুক্রবার থেকে গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট ৫৯৯ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত রয়েছে। আজ থেকে বৃষ্টিপাত কমবে।
দুর্ভোগে মানুষ
দুই মহাসড়ক বন্ধ থাকার কারণে মানুষকে প্রচণ্ড রকমের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার লোকজনও একই দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। উপজেলার লোকজনদের কাউকে কাউকে হাঁটু থেকে বুকসমান পানি মাড়িয়ে গন্তব্যে ছুটতে দেখা গেছে।
এর আগে ২০১৯ সালে সড়কে এভাবে পানি ওঠার কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম-বান্দরবানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনো চন্দনাইশের হাশিমপুর, কসাইপাড়া, বড়পাড়া, দক্ষিণ হাশিমপুর, দোহাজারি, সাতকানিয়ার কেরানীহাট, মৌলভির দোকান এবং লোহাগাড়ার বিভিন্ন অংশে পানি উঠেছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এবার বেশি সময় ধরে সড়ক পানিতে তলিয়ে আছে। এবার পানির পরিমাণও বেশি।
সাতকানিয়ার কেরানীহাট, কাঞ্চনা ইউনিয়ন, এওছিয়া, নলুয়া, বাজালিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কাঞ্চনা বিশ্বাসপাড়ার বাসিন্দা টুটুল বিশ্বাস বলেন, সোমবার থেকে পানি উঠেছে। ঘরে এখন বুকসমান পানি। গতকাল রাতে এলাকার উত্তম বিশ্বাসের দোতলা বাড়িতে ২৫টি পরিবারের সদস্যেরা গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন।
উত্তমের ঘরটি তালাবন্ধ ছিল। কিন্তু তিনি শহর থেকে ফোনে বলেছেন, তালা ভেঙে ঘরে আশ্রয় নিতে। তারপর তালা ভেঙে সবাই ওই বাড়িতে গিয়ে ওঠেন।
চন্দনাইশের বাগিচাহাটের ভান্ডারিপাড়ার কৃষক আসহাব উদ্দীন বলেন, তিন–চার বছর আগেও একবার এ রকম অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তখন এত বেশি পানি ছিল না। তবে যান চলাচল তখনো বন্ধ ছিল।
চন্দনাইশ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা জিমরান মোহাম্মদ সায়েক প্রথম আলোকে বলেন, সোমবার রাত থেকে সড়কে পানি বেড়েছে। পানির কারণে কিছু যানবাহন নষ্ট কিংবা উল্টে গেছে। দুই দিকে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানির পরিমাণ বেশি। তাই গাড়ি চলছে না। এ ছাড়া চন্দনাইশের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে।
জেলা, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসাবে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সাড়ে ২২ হাজার পরিবার, চন্দনাইশে ৫ হাজার, পটিয়ায় ১৬ হাজার ৫৯৫ পরিবার এবং লোহাগাড়ায় ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দী রয়েছে।