মেট্রোরেলের আয়ে ঋণের কিস্তির টাকা উঠছে না

মেট্রোরেলফাইল ছবি

ঢাকার মেট্রোরেলে এখন যাত্রী ঠাসাঠাসি করে চলাচল করছে। বিশেষ করে অফিস শুরু ও ছুটির ব্যস্ত সময়ে অনেকেই প্রথম চেষ্টায় মেট্রোরেলে উঠতে পারছেন না। এরপরও যাত্রী–ভাড়া থেকে মেট্রোরেলে যে আয় হয়, তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা যাবে না।

মেট্রোরেলের বর্তমানে আয়ের ধারা এবং ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে এই ধারণা পাওয়া গেছে। মেট্রোরেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করছে। দিনে গড়ে চার লাখের মতো যাত্রী চলাচল করেন। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের সম্প্রসারণের কাজ চলমান। মেট্রোরেলের এই লাইনের নাম এমআরটি-৬। সরকার আরও পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে।

আরও পড়ুন
বর্তমানে মেট্রোরেলের আয় ও ঋণের কিস্তি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে টিকিট বিক্রি থেকে অনিরীক্ষিত (প্রভিশনাল) আয় ছিল ৪০০ কোটি টাকার মতো। সেখানে আগামী ২০৩০-৩১ সাল পর্যন্ত বছরে ঋণের কিস্তি হিসেবে ৪৬৫ কোটি থেকে ৭৪০ কোটি টাকা দিতে হবে।

এমআরটি-৬ প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ব্যস্ত সময়ে সাড়ে তিন মিনিট পরপর ট্রেন চলাচল করবে। এখন ৮-১২ মিনিটের ব্যবধানে ট্রেন চলাচল করে। এ ছাড়া রাত ১০টার পর মেট্রোরেল চলাচল করে না।

বর্তমানে মেট্রোরেলের আয় ও ঋণের কিস্তি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে টিকিট বিক্রি থেকে অনিরীক্ষিত (প্রভিশনাল) আয় ছিল ৪০০ কোটি টাকার মতো। সেখানে আগামী ২০৩০-৩১ সাল পর্যন্ত বছরে ঋণের কিস্তি হিসেবে ৪৬৫ কোটি থেকে ৭৪০ কোটি টাকা দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেলে যাতায়াতের ওপর সরকার এখনো ভ্যাট মওকুফ রেখেছে। এরপরও আশপাশের দেশের তুলনায় ঢাকার মেট্রোরেলের যাত্রী–ভাড়া বেশি। এ অবস্থায় ভাড়া বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি করার সুযোগ খুব একটা নেই। মেট্রোরেলের চলাচল বাড়ানো, স্টেশনের কাছে গাড়ি পার্কিং ও বিপণিবিতান ভাড়া দিয়েও আয় বৃদ্ধির সুযোগ আছে।

আরও পড়ুন
ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো এবং আরও বেশি সময় মেট্রোরেল চলাচল নিশ্চিত করতে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া টিকিট বিক্রির বাইরে স্টেশনগুলোর অব্যবহৃত জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
ফারুক আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিএমটিসিএল

২০১২ সালে উত্তরা থেকে মিরপুর এবং ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর চালু হয় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ। শুরুতে মতিঝিল পর্যন্ত এই মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। এখন সব মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫৯ শতাংশ অর্থ জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে।

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো এবং আরও বেশি সময় মেট্রোরেল চলাচল নিশ্চিত করতে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া টিকিট বিক্রির বাইরে স্টেশনগুলোর অব্যবহৃত জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন
মেট্রোরেল পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, টিকিট বিক্রি থেকে আয় ৭০০ কোটি টাকা হলেও নির্মাণ ব্যয় তুলতে ৫০ বছর লেগে যাবে। মেট্রোরেল যত পুরোনো হবে, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যয় বাড়বে।

ঋণের মূল কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে

ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, মেট্রোরেলের নির্মাণকালীন ১০ বছর পর্যন্ত জাইকার ঋণের মূল কিস্তি দিতে হয়নি, যা গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে পরিচিত। ২০২৩ সালের জুন থেকে সীমিত আকারে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭৫ কোটি টাকার মতো পরিশোধ করা হয়েছে। এ বছর আরও ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। তবে আগামী বছরের মে থেকে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে তখন থেকে পরবর্তী এক বছরে প্রায় ৪৬৫ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।

ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, এরপর পর্যায়ক্রমে ঋণের কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ আরও বাড়বে। ২০৩০-৩১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এমআরটি-৬ নির্মাণে নেওয়া ঋণের কিস্তি হিসেবে ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ এই সময়ে গড়ে বছরে ৭৪০ কোটি টাকা ঋণের কিস্তি বাবদ পরিশোধ করতে হবে।

মেট্রোরেল নির্মাণে জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করেছে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। অন্যদিকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ টিকিট বিক্রির আয় থেকে ঋণ বাবদ অর্থ মন্ত্রণালয়কে টাকা পরিশোধ করে। অর্থ মন্ত্রণালয় জাইকার ঋণ পরিশোধ করে।

আরও পড়ুন
এমনিতেই ঢাকার মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় বেশি হয়েছে। ফলে আশপাশের দেশের তুলনায় ভাড়া বেশি। এর থেকে ভাড়া বৃদ্ধি কঠিন। দিন দিন রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বাড়বে। এখন ট্রেনের সংখ্যা ও বেশি সময় চালিয়ে আয় বাড়াতে হবে। অযৌক্তিক খরচ যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অধ্যাপক সামছুল হক, পুরকৌশল বিভাগ, বুয়েট

এমআরটি–৬ প্রকল্পের জন্য পাঁচটি আলাদা চুক্তির মাধ্যমে জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এই ঋণ সুদ–আসলে প্রতিবছর দুটি কিস্তিতে আগামী ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের কিস্তির টাকার পরিমাণও বেড়ে যাবে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আরও পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। মেট্রোরেলের বাস্তবায়নাধীন নতুন প্রকল্পগুলোর ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, তাতে এমআরটি-৬–এর কয়েক গুণ ব্যয় করতে হবে। এর বড় অংশ আসবে ঋণ থেকে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বিপুল এই ঋণ মেট্রোরেলের আয় থেকে পরিশোধের সুযোগ নেই। ফলে সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে পরিশোধ করতে হবে। তিনি বলেন, এমআরটি লাইন-৬–এর ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে ব্যয় নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে।

আরও পড়ুন

আয় দিয়ে ঋণ পরিশোধে ৫০ বছরের বেশি লাগবে

ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিএমটিসিএলের অনিরীক্ষিত (প্রভিশনাল) আয় ৪০০ কোটি টাকার মতো। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টিকিট বিক্রি করে আয় ছিল প্রায় ২৪৪ কোটি টাকা। ২০২২ সালে আংশিক চালুর পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ২২ কোটি টাকার বেশি।

ট্রেনের সংখ্যা এবং মেট্রোরেলের চলাচলের সময় বাড়িয়ে সেটা ৫০০ কোটি টাকায় নেওয়া যাবে। কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হতে আরও বছর দুয়েক লাগবে। তখন আয় আরও বাড়বে। তবে দিন দিন মেট্রোরেলের পরিচালনা খরচও বাড়বে। কারণ, এখনো রক্ষণাবেক্ষণ এবং যন্ত্রপাতির দেখভাল করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আগামী বছর জানুয়ারি থেকে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষকেই রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় করতে হবে।

মেট্রোরেল পরিচালনায় যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, টিকিট বিক্রি থেকে আয় ৭০০ কোটি টাকা হলেও নির্মাণ ব্যয় তুলতে ৫০ বছর লেগে যাবে। মেট্রোরেল যত পুরোনো হবে, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যয় বাড়বে।

আরও পড়ুন

ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, শুধু বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে গত অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আগামী বছর থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় নিজেদের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বছরে ব্যয় দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে। অর্থাৎ মুনাফা কমে যাবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই ঢাকার মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় বেশি হয়েছে। ফলে আশপাশের দেশের তুলনায় ভাড়া বেশি। এর থেকে ভাড়া বৃদ্ধি কঠিন। দিন দিন রক্ষণাবেক্ষণ খরচও বাড়বে। এখন ট্রেনের সংখ্যা ও বেশি সময় চালিয়ে আয় বাড়াতে হবে। অযৌক্তিক খরচ যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেট্রোরেলের স্থাপনা বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিয়েও কিছুটা আয় বাড়ানো যায়।

অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, মেট্রোরেলের লাইন-৬ ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা দিয়ে গেছে। এটি নির্মাণ হয়েছে উড়ালপথে। অন্য লাইনগুলোতে এতটা যাত্রী না–ও হতে পারে। এ ছাড়া পাতালপথে ব্যয়ও বেশি। ফলে নতুন মেট্রোরেল নির্মাণে খরচের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ছাড়া বাড়তি আয় কীভাবে করা যায়, সেই বিষয় মাথায় রেখে নকশা করতে হবে।

আরও পড়ুন