চট্টগ্রাম ও দিনাজপুর
পাল্টাপাল্টি হামলা, সংঘর্ষ
চট্টগ্রামে নৌকার নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনার পর পাল্টা হামলা বিএনপির কার্যালয়ে। দিনাজপুরে পদযাত্রার গাড়িবহরে হামলা।
সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পদযাত্রার দ্বিতীয় দিনে গতকাল বুধবার চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। চট্টগ্রামে একটি উপনির্বাচনের নৌকার প্রার্থীর ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনার পর পাল্টা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে। দিনাজপুরে বিএনপির পদযাত্রায় আসা গাড়িবহরে হামলার ঘটনা নিয়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সংঘর্ষ হয়েছে।
বিএনপির পদযাত্রার প্রথম দিনে গত মঙ্গলবার দেশের সাতটি জেলায় বাধা, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। রাজধানী ঢাকায়ও পদযাত্রায় ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল। গতকাল ঢাকায় পদযাত্রার পাল্টা আওয়ামী লীগ শোভাযাত্রা করলেও দুটি কর্মসূচিই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। তবে চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনার মধ্য দিয়ে বিএনপির দুই দিনের পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হয়েছে।
চট্টগ্রামে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর। নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি শেষ হয় বিকেল পাঁচটার দিকে। কর্মসূচি শেষ হলে সেখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে পদযাত্রা থেকে ফেরার পথে বিএনপির কিছু কর্মী চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিন বাচ্চুর নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করেন।
নির্বাচনী কার্যালয়ে ইটপাটকেল ছোড়া হয় পার্শ্ববর্তী উড়ালসড়কের ওপর থেকে আর পাশের সড়ক থেকে। কার্যালয়ের পাশের এক দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির পদযাত্রা থেকে ফেরা লোকজনই ইটপাটকেল ছুড়ে মারেন। ওই সময় নৌকার প্রধান কার্যালয়ের বাইরে থাকা তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে দুটিতে মহিউদ্দিন বাচ্চুর পোস্টার লাগানো ছিল। আরেকটি গাড়ি হচ্ছে পুলিশের। কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করা হয়। তখন কার্যালয়ের ভেতরে ও আশপাশে থাকা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কর্মীরা ইটপাটকেল ছোড়া লোকজনকে ধাওয়া দেন।
পাল্টা বিএনপির কার্যালয়ে হামলা
নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুরের খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে জড়ো হতে শুরু করেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৫০০ নেতা-কর্মী জড়ো হন। বেশির ভাগের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা।
একপর্যায়ে কিছু নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে এক কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিএনপির কার্যালয়ে হামলা চালান। তাঁরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বিএনপির কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। কয়েকজনের হাতে ধারালো অস্ত্র (কিরিচ) দেখা গেছে। ওই সময় কার্যালয়ের সামনের নুর আহমদ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন পথচারীরা। বন্ধ হয়ে যায় আশপাশের দোকানপাট।
হামলার সময় বিএনপির কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল এবং সেখানে থাকা একটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
অন্যদিকে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সড়কে বিএনপির বিভিন্ন ব্যানার জড়ো করে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। আসতে থাকে আরও দুটি মিছিল। তাঁরা দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশ তাঁদের দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন। ঘটনাস্থলে মোতায়েন হয় অতিরিক্ত তিন প্লাটুন পুলিশ। বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আনা হয় পুলিশের দুটি সাঁজোয়া যান।
সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটের দিকে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে যান আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা। এরপর স্বাভাবিক হয় যান চলাচল।
চট্টগ্রাম নগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম বিএনপির কার্যালয়ে আওয়ামী যুবলীগের হামলা এই প্রথমবারের মতো। তারা কার্যালয়ের ভেতরে-বাইরে যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা অবর্ণনীয়।
তবে চট্টগ্রাম-১০ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন বিএনপির নেতা শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, তাঁরা তাঁদের কার্যালয়ের হামলার ঘটনার ব্যাপারে মামলা করবেন।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করেছে বিএনপি। আমাদের কয়েকজন আহত হয়েছেন। আমরা নেতারা এখন কার্যালয়ে যাচ্ছি। এ ঘটনার পর বিএনপির কার্যালয়ের দিকে মিছিল গেছে বলে শুনেছি।’
তবে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় পুলিশ কাউকে আটক করেনি। ঘটনাস্থলে থাকা নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।
দিনাজপুরে পদযাত্রার গাড়িবহরে হামলা, সংঘর্ষ দিনাজপুরে বিএনপির পদযাত্রায় আসা গাড়িবহরে হামলা করা হয়েছে। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ এই হামলা করেছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। এ সময় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভাঙচুর করা হয়েছে কয়েকটি গাড়ি।
গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এ ঘটনা ঘটে। বেলা দুইটা থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ চলে বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত। সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বাঁশ, কাঠ, রডসহ ধারালো অস্ত্র হাতে ইটপাটকেল ছোড়েন। জবাবে বিএনপির নেতা-কর্মীরাও লাঠি হাতে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সময় পদযাত্রায় আসা বিএনপির কয়েকজন কর্মী আহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিএনপির পদযাত্রায় অংশ নিতে বেলা দুইটায় রংপুর থেকে ১০টি বাস দিনাজপুর শহরের দিকে যাচ্ছিল। বাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বাঁশেরহাট এলাকায় পৌঁছালে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী বাসগুলো থামিয়ে দেন। গাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। জবাবে বাস থেকে নেমে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পরিস্থিতি সংঘর্ষে রূপ নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মামুনুর রশিদ বলেন, ‘পদযাত্রায় অংশ নেওয়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন উসকানিমূলক কথা বলছিলেন বলে জেনেছি। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গন্ডগোল বাধে। থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।’
খবর পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশ ও কোতোয়ালি থানার পুলিশের দুটি প্রতিনিধিদল বাঁশেরহাট এলাকায় এসে বিকেল সোয়া চারটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীরুল ইসলাম বলেন, উভয় পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে।
দিনাজপুর শহরের ইনস্টিটিউট মাঠে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বেলা তিনটায় পদযাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রধান অতিথি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন বিকেল সাড়ে চারটায়। সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব অভিযোগ করেন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ৫০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।
‘দুই দিনের পদযাত্রায় আহত ৩০০০’
গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দিনাজপুরে পদযাত্রা কর্মসূচিতে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রংপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, পঞ্চগড় ও সৈয়দপুরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বহনকারী গাড়িতে হামলা চালিয়ে শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগ।
রুহুল কবির আরও অভিযোগ করেন, তাঁদের দুই দিনের পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা ও গুলিতে একজনকে হত্যা এবং অন্তত তিন হাজার নেতা-কর্মীকে আহত করা হয়েছে।
বিএনপির এই নেতা গত দুই মাসের হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের চিত্রও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত ১৯ মে থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩১০টি মামলা করা হয়েছে। এতে ১১ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।