মাদকাসক্ত সাজিয়ে ২২ দিন আটক: ‘ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে’ দেখার অনুরোধ রেইনবোর
সাভারের আশুলিয়ার পোশাক কারখানার কর্মী ফিরোজ আহমেদকে মাদকসেবী সাজিয়ে ২২ দিন আটকে রাখার বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেনি রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র। এ ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাবে ‘বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে’ দেখার কথা বলেছেন রেইনবোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এম কাউসার। সোমবার প্রথম আলোকে এমন তথ্যই জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা উত্তর অঞ্চলের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান।
সুস্থ ফিরোজকে মাদকাসক্তি সাজিয়ে তাঁর প্রথম স্ত্রী আকলিমা আক্তারের পরিবার উত্তরার রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২২ দিন আটকে রাখে। বিষয়টি জানাজানি হলে গত ৪ অক্টোবর রাতে তড়িঘড়ি করে ফিরোজকে আকলিমার পরিবারের কাছেই পৌঁছে দেয় রেইনবো। সেদিন রাতে মাদক নিরাময় কেন্দ্র থেকে ছাড়া পেলেও তাঁর জিম্মিদশা কাটেনি। আকলিমার পরিবার আবার তাঁকে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। তবে এক দিন পর (৫ অক্টোবর) রাতে সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি নাটোরে যান তিনি।
এ ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে। প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে গত ৬ অক্টোবর রেইনবোর ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় সংস্থাটির ঢাকা উত্তর অঞ্চলের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে সেই নোটিশের জবাবও দিতে বলা হয়।
নোটিশে বলা হয়, উত্তরার রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র ফিরোজকে বিধিবহির্ভূতভাবে আটকে রেখেছিল। এমনকি মাদকাসক্তি প্রমাণে রোগী ভর্তির সাত দিনের মধ্যে ক্লিনিক্যাল ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করার কথা থাকলেও সেটি তারা করেনি। ওই পরীক্ষা করা হয় ২০ দিন পর। মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র ও মাদকাসক্তি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও পরিচালনা বিধিমালা অনুযায়ী, চিকিৎসা গ্রহণে অনিচ্ছুক রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবকের লিখিত অনুমতি গ্রহণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট থানা এবং স্থানীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়কে অবহিত করতে হয়। কিন্তু ফিরোজকে ভর্তির ক্ষেত্রে এগুলোর কোনোটিই মানা হয়নি।
কারণ দর্শানোর নোটিশে আরও বলা হয়, লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ এবং বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের কারণে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে কেন বাতিল করা হবে না, তা লিখিতভাবে জানাতে বলা হয় রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা উত্তর অঞ্চলের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, রেইনবো কারণ দর্শানোর নোটিশের সদুত্তর দিতে পারেনি। তারা বিষয়টিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের জবাব পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে রেইনবোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ এম কাউসার প্রথম আলোকে বলেন, ফিরোজকে এভাবে আটকে রাখা তাঁদের ভুল হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক বোরহান দেওয়ান এই ঘটনার জন্য দায়ী বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে বিষয়টি জেনে তিনি কেন ব্যবস্থা নেননি, তার কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
এদিকে ভুক্তভোগী ফিরোজ প্রথম আলোর কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ১২ সেপ্টেম্বর জিরাবোতে আকলিমার (প্রথম স্ত্রী) বাসায় যান ফিরোজ। এ সময় আকলিমার ভাই মোজাম্মেল হক মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে ফিরোজকে আটকে রাখেন। পরদিন (১৩ সেপ্টেম্বর) তিনজন এসে তাঁকে একটি প্রাইভেট কারে তুলে উত্তরার রেইনবো মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাঁদের একজন হলেন বোরহান দেওয়ান (রেইনবোর ব্যবস্থাপক)।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক বোরহান দেওয়ানের কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রশ্ন শুনে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আর তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি।
ফিরোজ ১২ বছর আগে আকলিমাকে বিয়ে করেন। এর তিন বছর পর তিনি গোপনে নাজমা আক্তার নামের এক নারীকে বিয়ে করেন। আকলিমা থাকেন আশুলিয়ার জিরাবোতে। আর নাজমা থাকেন সাভারে। তবে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি ৯ বছর ধরে গোপন ছিল।
ফিরোজ আহমেদ বলেন, বিয়ের দুই বছর পর জানতে পারেন, শারীরিক সমস্যার কারণে আকলিমা মা হতে পারবেন না। এ কারণেই তিনি গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। চার মাস আগে আকলিমার পরিবার বিষয়টি জেনে যায়। তখন চার দিন জিরাবোতে তাঁকে (ফিরোজ) আটকে রাখে। তাঁর ভাষ্য, মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করতেই আকলিমার পরিবার তাঁকে মাদকসেবী সাজিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে আটকে রেখেছিল। তবে তাঁর প্রথম স্ত্রী আকলিমা আক্তারের ভাষ্য, মাদক সেবন করে ফিরোজ তাঁর ওপর বিভিন্ন সময় নির্যাতন করতেন। এ কারণেই তাঁকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।