১৩ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের প্রায় ৩২ শতাংশ মোটরসাইকেল আরোহী
১৩ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ হাজার ৭৯৮ জন মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় মাছবোঝাই একটি ছোট ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে দুই তরুণের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে নিহত মো. রাকিবের বয়স ২১ আর মো. জিয়াদের বয়স ২০ বছর। রাকিব, জিহাদসহ ছয় বন্ধু তিনটি মোটরসাইকেলে করে কক্সবাজার থেকে রাঙামাটির সাজেক পর্যটনকেন্দ্রে যাচ্ছিলেন।
সড়কে এখন বড় ঝুঁকির যানে পরিণত হয়েছে মোটরসাইকেল। গত এক দশকে দেশে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। একই সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির হার।
পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ১৩ মাসের হিসাব বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ৩২ দশমিক ১৪ শতাংশই মোটরসাইকেল আরোহী। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ৫ বছরের তথ্য বলছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ মোটরসাইকেলের আরোহী। সরকারি ও বেসরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির বড় অংশই বয়সে তরুণ, আছে শিশুও।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩০ হাজার ৭৭৩টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৩ হাজার ২৪৬ জন। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৫১ হাজার মানুষ।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান আবু মমতাজ মো. সাদউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সব ধরনের দুর্ঘটনা কমাতে তাঁরা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কর্মকৌশল ঠিক করছেন। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমানো তাঁদের অগ্রাধিকারে রয়েছে।
দুর্ঘটনায় মৃত্যু বাড়াচ্ছে মোটরসাইকেল
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৩ মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৫ জন নিহত হয়েছেন। এসব নিহত মানুষের মধ্যে অন্তত ১ হাজার ৭৯৮ জন মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন; অর্থাৎ নিহতের ৩২ দশমিক ১৪ শতাংশই মোটরসাইকেল আরোহী।
বিআরটিএর তথ্য বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ৮০ শতাংশ চালকের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। অধিকাংশ চালক, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে হেলমেট ব্যবহার করেন না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৮৬৪ জন মোটরসাইকেল আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট প্রাণহানির ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ সময় আরও প্রায় ১০ হাজার মোটরসাইকেল আরোহী আহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোটরসাইকেলের চালক কিংবা আরোহীদের সুরক্ষা নেই। ফলে দুর্ঘটনায় এই যানের আরোহীদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়। আহত ব্যক্তিদের জীবনভর পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়ে কাটাতে হয়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৮০৬টি শিশু মারা গেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৮৫ শিশু ছিল মোটরসাইকেলের আরোহী; অর্থাৎ নিহত শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশ মোটরসাইকেলের আরোহী।
পঙ্গু হাসপাতালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার রোগীতে ভরা
লোকমান হোসেন সরকার ১৮ দিন ধরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর ডান হাত ভেঙে গেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানেও ক্ষত। লোকমানের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়। বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে দোকানে যাওয়ার সময় বাস ধাক্কা দিলে তিনি আহত হন।
লোকমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সৌদি আরবে থাকেন। দেশে ছুটিতে এসে দুর্ঘটনায় পড়েন। এখন বিদেশে ফিরে যাওয়া নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ চিকিৎসা নেয় নিটোরে। নিটোর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুন থেকে গত জুন পর্যন্ত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার ২২ হাজার ৬৪৫ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মানুষের সংখ্যা ৮ হাজার ১৫০।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাপী এটা প্রতিষ্ঠিত যে স্থিতিশীলতা (স্ট্যাবিলিটি) বিবেচনায় সুশৃঙ্খল সড়কেও সাধারণ যানবাহনের চেয়ে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের মতো বিশৃঙ্খল পরিবেশে ঝুঁকি আরও বেশি। স্বভাবজাতভাবেই যেহেতু ঝুঁকি বেশি, তাই দুই পদ্ধতিতে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রথমত, নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা ও গণপরিবহন সহজলভ্য করতে হবে। যাতে মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরতা কমে যায়।