রজার মিলার-এমেকাদের দেশের গাছে দোহারে ঘরবাড়ি

লরির ৪০ ফুট লম্বা পাটাতনে রাখা তিনটি গুঁড়ি
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার দোহারের পালামগঞ্জের বাঁশতলা বাজারের পাশের সড়কের ধারে এসে থেমেছে বড় এক লরি। লরির ইঞ্জিনের পেছনে যুক্ত মালামাল টানার ৪০ ফুট লম্বা খোলা পাটাতন। তার ওপর গাছের তিনটি গুঁড়ি। দুটি গুঁড়ি লরিতে এঁটে গেছে। অপর গুঁড়িটি পাটাতনের চেয়েও লম্বা। ফলে গুঁড়িটির বেশ খানিকটা অংশ পাটাতন ছাড়িয়ে গেছে। দেখে মনে পড়ে রূপকথার সেই কথা—‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীজ’।

গত সপ্তাহের শেষ দিকে শরতের ঝলমলে রোদেলা দুপুরে লাল রঙের এই বিশালাকৃতির গাছের গুঁড়িগুলো দেখে বেশ অবাকই লাগল। সড়কের যে পাশে লরিটি এসে থেমেছে, তার অপর পাশে একটি করাতকল। সেখানে যান্ত্রিক করাতে চেরাই করা হচ্ছে এ রকমই এক বিশালাকার গুঁড়ি। আশপাশে চেরাইয়ের জন্য ফেলে রাখা হয়েছে বাকল ছাড়ানো এমন আরও ডজনখানেক গুঁড়ি। করাতকলের কর্মীরা এগুলোকে বলেন ‘গুল’।

বোঝাই যাচ্ছে, এ ধরনের একহারা লম্বা, বড় বেড়ের প্রকাণ্ড গাছ আমাদের দেশে জন্মে না। তবে কোন দেশ থেকে এল এই প্রাণহীন মহিরুহ!

করাতকলটির মালিক মো. আলাউদ্দিন যা বললেন, তা শুনে বিস্ময়কর লাগল। এ যেন রীতিমতো ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদী’ পেরিয়ে আসার ভ্রমণকাহিনি।

গুঁড়িগুলো এসেছে সুদূর আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। সেখান থেকে আমদানি করা এসব গাছের কাঠ দিয়ে ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, বিক্রমপুর এলাকায় তৈরি করা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী টিন-কাঠের ঘরবাড়ি।

রজার-এমেকাদের দেশের গাছ

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ক্যামেরুনের বিখ্যাত ফুটবলার রজার মিলার কথা ফুটবলপ্রেমীদের ভোলার কথা নয়। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে বিরতির পর মাঠে নেমেই গোল করেনি তিনি। তারপর সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে অভিনব মুদ্রায় নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে উদ্‌যাপন। এভাবেই তিনি সেবার ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। আবার ঢাকার মাঠ মাতানো নাইজেরিয়ান ফুটবলার এমেকা ইজিউগোর কথাও স্মরণে থাকবে অনেকের। মোহামেডানের হয়ে ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন তিনি। পারে কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে নাইজেরিয়া দলে ছিলেন এমেকা।

করাতকলে চেরাইয়ের অপেক্ষায় বাকল ছাড়ানো গাছের গুঁড়ি
ছবি: প্রথম আলো

গাছের কথা বলতে গিয়ে রজার-এমেকার গল্পজুড়ে দেওয়াটা কিছুটা খটমটে লাগতে পারে। কিন্তু এই গল্প বলার কারণ আছে। কারণ হলো, রজারের ক্যামেরুন ও এমেকার নাইজেরিয়া থেকেই দোহারের প্রত্যন্ত গ্রামে গাছের গুঁড়িগুলো আসছে।

লরির চালক নাহিদ হোসেন বললেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তারা এই গুঁড়িগুলো এনেছেন। এখন গুঁড়ি নামানোর অপেক্ষায় আছেন।

তিনটি গুঁড়ির ওজন ৩২ মেট্রিক টন। আনতে ভাড়া পড়ছে ৫৭ হাজার টাকা। জ্বালানির তেলের দাম বাড়ায় ভাড়া বেড়েছে। আগে ভাড়া ছিল ৪০ হাজার টাকার মতো।

নজর আফ্রিকায়

দোহার অঞ্চলের লোকজন গাছটিকে ‘লোহাকাঠ’ নামে ডাকে। আলাউদ্দিন জানালেন, এই গাছের কাঠ লোহার মতোই শক্তপোক্ত। সে জন্যই লোকমুখে তা লোহাকাঠ নামে পরিচিতি পেয়েছে। তবে আসল নাম ‘ওকান কাঠ’। সাধারণত ঘর তৈরিতে এসব কাঠ ব্যবহৃত হয়। তেমন মসৃণ হয় না বলে এই কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরির চল কম। তাঁরা ঘরের খুঁটি, দরজার চৌকাট, কড়ি বরগা, মেঝে বা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য মাপ অনুসারে এই গুঁড়ি চোরাই করেন। পাকা ঘরের দরজার চৌকাঠ ও দরজার জন্য এই কাঠের কদর বেশি।

আরও পড়ুন

আলাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি ঘনফুট (সিএফটি) লোহাকাঠ চেরাইয়ে খরচ পড়ে ৪০ টাকা। তবে সব করাতকলে এত বড় আকারের গুঁড়ি চেরাইয়ের ব্যবস্থা নেই। গুঁড়িগুলো ৪০ থেকে ৪৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। একেকটির ওজন ৮ থেকে ১৫ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। দোহারে তাঁর ছাড়া আরও একটি করাতকলে এই গুঁড়ি চেরাই করা হয়। কাঠ ব্যবসায়ীরা গুঁড়িগুলো চট্টগ্রাম থেকে দোহারে নিয়ে আসেন। তারপর করাতকলে নানা আকারে তা চেরাই করা হয়।

কথা হয় কাঠ ব্যবসায়ী আবুল খন্দকারের সঙ্গে। দোহারের জয়পাড়ায় খন্দকার নজরুল অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে তাঁর কাঠের আড়ত আছে। আড়তে বসে তিনি জানালেন, কয়েক বছর ধরে আফ্রিকান লোহাকাঠ আমদানি হচ্ছে। এগুলো তাঁরা নিজেরা আমদানি করেন না। চট্টগ্রামে বড় বড় আমদানিকারক আছেন। আমদানিকারকেরাই আফ্রিকা থেকে জাহাজে করে এগুলো চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। পরে তাঁরা চট্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসেন।

সব করাতকলে এত বড় আকারের গুঁড়ি চেরাইয়ের ব্যবস্থা নেই
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

আবুল খন্দকার বলেন, আগে কাঠের প্রধান চালান আসত মিয়ানমার থেকে। দেশটির সেগুন, গর্জন, চাপালিশ—এসব কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র থেকে ঘরবাড়ি তৈরি হতো।

কিন্তু মিয়ানমার সংকটের জেরে দেশটি থেকে কাঠ আমদানি কমতে থাকে। তার পরিবর্তে আফ্রিকা থেকে কাঠ আমদানি শুরু হয়। এখন নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুন থেকেই বেশি আমদানি হয়।

লোহাকাঠের কদর

ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জে টিন-কাঠ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরির চল আছে। এই এলাকাগুলোতে এই ধরনের বাড়ি করতে এখন লোহাকাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিক্রমপুর এলাকাটির লোকজন বহু বছর ধরে টিন-কাঠের তৈরি বাড়িতে বসবাস করে অভ্যস্ত। এলাকাটি নদীর ভাঙনকবলিত। ফলে এখানে এসব ঘর সহজেই এক জায়গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায়। অবশ্য এলাকাটিতে এখন অনেকেই পাকা ঘরবাড়ি তৈরি করছে। কিন্তু তাই বলে টিন-কাঠের ঘরবাড়ির চল উঠে যায়নি। শৌখিন অনেকে টিন-কাঠের নকশা করা দোতলা বাড়ি করেন। এসব বাড়ি তৈরিতে ২ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এ ধরনের বাড়ি তৈরির জন্য লোহাকাঠের বেশ চাহিদা রয়েছে।

দোহারের করম আলী মোড়ের মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী শফিক ব্যাপারী জানালেন, এক ট্রাক মাল আনতে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা পড়ে যায়। বিক্রি হতে সময় লাগে মাসখানেক। কিন্তু এখন গাড়িভাড়া বেড়ে গেছে। ডলারের দামও বাড়তি। এ কারণে এই কাঠের দামও বেড়ে গেছে। আগে প্রতি ঘনফুট লোহাকাঠের দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা। কিন্তু এখন তার দাম ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় এই কাঠের ব্যবসায় এখন বেশ মন্দা চলছে।