নাশকতার সন্দেহ, জড়িত কারা, জানা নেই পুলিশের

ঢাকার গোপীবাগে জ্বলছে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনফাইল ছবি

ঢাকার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটিতে পরিকল্পনা করেই আগুন দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে রেল পুলিশ। তবে এই ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, তা রেল পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি।

রেল পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল শনিবার ট্রেনের যাত্রী, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাঁদের বরাত দিয়ে রেল পুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে আগুন লাগেনি। ট্রেনটির ‘চ’ কোচের মাঝামাঝির একটি আসনে শুরুতে আগুন জ্বলে ওঠে। সেখান থেকেই অন্য বগিতে ছড়িয়ে পড়ে।

ঢাকার কমলাপুরের উদ্দেশে আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস সর্বশেষ থেমেছিল ফরিদপুরের ভাঙ্গা স্টেশনে। রেল পুলিশ জানিয়েছে, ওই স্টেশনে কোনো সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা নেই। ট্রেনেও কোনো সিসি ক্যামেরা নেই।

ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, যাত্রী বেশে কেউ আগুন দিয়েছে। কে বা কারা আগুন দিয়েছে, সেটি নিশ্চিত হতে তদন্ত চলছে।

ঢাকায় শুক্রবার রাত নয়টার দিকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে তিনটি কোচ পুড়ে যায়। মারা যান চারজন। এর আগে গত ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনে চারজনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ঘটনায়ও নাশকতার দাবি করেছিল পুলিশ। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ওই দিন তেজগাঁও স্টেশনে সব কটি সিসি ক্যামেরা বিকল ছিল।

ট্রেনে আগুনের ঘটনায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের পরিচালক নুরুল ইসলাম গতকাল ঢাকা রেলওয়ে থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আগুন দিয়ে নাশকতা ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। আসামির কোনো সংখ্যা বা নাম উল্লেখ করা হয়নি।

এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্তে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আর রেলওয়ে বিভিন্ন গন্তব্যের ৫২টি ট্রেনের চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেন বন্ধের সিদ্ধান্ত সাময়িক।

শিকল টানা পুলিশ সদস্য যা বললেন

রেল পুলিশ জানিয়েছে, বেনাপোল এক্সপ্রেসের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের সাত সদস্য। তাঁদের একজন রাজবাড়ী রেলওয়ে থানার কনস্টেবল মোহাম্মদ আলী। তিনি ট্রেনটির ‘চ’ কোচে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আগুন লাগার পর তিনিই শিকল (চেইন) টেনে ট্রেন থামান।

কনস্টেবল মোহাম্মদ আলী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তখন ট্রেনের ‘চ’ কোচের পেছনের দরজায় ছিলেন। হঠাৎ যাত্রীদের চিৎকার শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখেন আগুন জ্বলছে। বগিতে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি দ্রুত ট্রেন থামাতে শিকল টেনে ধরেন। তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেনটি থেমে যায়।

ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী পায়ে আঘাত পেয়েছেন। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রাজবাড়ীতে ফিরে গেছেন। ট্রেনে আগুন কীভাবে লেগেছে, তা তিনি জানাতে পারেননি।

রেল পুলিশের ধারণা, যাত্রী বেশে ট্রেনে ভ্রমণকারী এক বা একাধিক ব্যক্তি দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে আগুন দিয়েছে। তবে কোন ধরনের দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা হয়েছে, তা তারা জানতে পারেনি।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) আগুন দেওয়ার দায়ে কাজী মনসুর আলম নামে যুবদলের এক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ভিডিও কনফারেন্সে ১০ থেকে ১২ জনের পরিকল্পনায় ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছে। কাজী মনসুরকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তাঁর মুঠোফোন ঘেঁটে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবীসহ আটজনকে গতকাল শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গতকাল তাঁকে নভেম্বর মাসে যাত্রাবাড়ী থানায় করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলায় তাঁর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়, বেনাপোল এক্সপ্রেসে ট্রেনে আগুন দেওয়ার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থদাতা ও ইন্ধনদাতা নবী উল্লাহ।

আওয়ামী লীগও ট্রেনে আগুনের জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছে। অন্যদিকে বিএনপি ট্রেনে আগুনের ঘটনায় জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের দাবি করেছে।

বিপুল নিরাপত্তার পরও আগুন

রেলপথ মন্ত্রণালয় গত ২০ ডিসেম্বর জানায়, সে দিন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় চারটি ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া রেললাইন কেটে ফেলার একটি ঘটনা ঘটানো হয়। এসব ঘটনায় মোট পাঁচজনের মৃত্যু হয়। শুক্রবারের ঘটনায় ট্রেনে আগুনের সংখ্যা ৫ এবং মৃত্যু বেড়ে ৯ জনে দাঁড়ায়। এসব ঘটনার বাইরে রেললাইনে আরও অন্তত ১৯টি অগ্নিসংযোগ এবং ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

ঢাকায় তেজগাঁওয়ে আগুনের পর বিভিন্ন পথে আটটি ট্রেনের চলাচল স্থগিত করা হয় এবং দুটি ট্রেনের চলাচল সীমিত করা হয়। রেলপথে নিরাপত্তাও বাড়ানো হয়। রেলওয়ে জানিয়েছে, রেল পুলিশের পাশাপাশি ২ হাজার ৭০০ আনসার সদস্য ট্রেনের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন। আর রেললাইনের নিরাপত্তায় রয়েছেন ১৩ হাজার আনসার সদস্য।

পুলিশ ও র‍্যাবের পক্ষ থেকে নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিনের আগে নাশকতার আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছিল। গত শুক্রবার সকালে রাজধানীর কাকরাইলে ভোটের নিরাপত্তাসংক্রান্ত এক ব্রিফিংয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছিলেন, এবারের নির্বাচনে একটি গোষ্ঠী নাশকতার পরিকল্পনা করেছে। মাগুরায় ছাত্রদলের একজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর সহিংসতা ও নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।

লাশের খোঁজে স্বজনেরা

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ট্রেনে আগুনে নিহত চারজনের মরদেহের মধ্যে তাঁদের স্বজন রয়েছেন কি না, সেটি নিশ্চিত হতে রেলওয়ে পুলিশের কাছে আবেদন জানিয়েছেন পাঁচ ব্যক্তি।

ঢাকা রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেতাফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মাধ্যমে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার পর মিল পেলে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

রেলওয়ে পুলিশের কাছে আবেদনকারী চারজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিখোঁজ তিনজন নারী ও একজন যুবক। তবে শিশুর লাশের দাবিদার কাউকে পাওয়া যায়নি।

আবেদনকারীদের একজন চিকিৎসক দিবাকর চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বোন চন্দ্রিমা চৌধুরী রাজবাড়ী থেকে শুক্রবার বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকায় আসছিলেন। আগুনের ঘটনার পর তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। কোথাও বোনের সন্ধান পাননি তিনি।

নাতাশা জেসমিন (২৫) নামের এক নারী নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন তাঁর স্বামী আসিফ মো. খান। তিনি বলেন, আগুন লাগার পর ট্রেনের জানালা দিয়ে তাঁকে লোকজন বের করে আনে। তাঁর স্ত্রীকে বের করা যায়নি।

রিয়াসাত সামিট নামের একজন বলেন, রাজবাড়ী থেকে বেনাপোল এক্সপ্রেসে ঢাকায় আসছিলেন তাঁর ছয় স্বজন, যাঁরা এক পরিবারের। শিশুসহ পাঁচজনের সন্ধান পাওয়া গেলেও এলিনা ইয়াসমিন নামের এক নারীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন