খালেদা জিয়া: বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও আপসহীন রাজনীতিক

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াছবি: বিএনপির ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

ডিসেম্বরের শুরুতে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৪৮ বছর বয়সী টিপু সুলতান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) এ তৃণমূল কর্মীর হাতের সেই প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আমি বেগম খালেদা জিয়াকে নিজের কিডনি দান করতে চাই।’

১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে টিপু সুলতানের সেই ভিডিও দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গত ২৩ নভেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দেশজুড়ে উদ্বেগ বিরাজ করছিল। এরপর থেকে টিপু হাসপাতালের ফটকের উল্টো দিকের ফুটপাতেই দিন কাটাচ্ছিলেন; প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, নেত্রীর সুস্থতার খবর না পাওয়া পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে নড়বেন না।

আল-জাজিরাকে বিএনপির এই কর্মী বলেছিলেন, ‘তিনি আমার মায়ের মতো। গণতন্ত্রের জন্য তিনি সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। আমার একটাই প্রার্থনা, সৃষ্টিকর্তা যেন তাঁকে আগামী নির্বাচন দেখার সুযোগ দেন।’ তিনি মূলত ১২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছিলেন।

কিন্তু সেই সুযোগ আর হলো না। ৩০ ডিসেম্বর ভোরে ৭৯ বছর বয়সে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন খালেদা জিয়া। ফেসবুকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বিএনপি জানায়, ‘আমাদের প্রিয় জাতীয় নেতা আর আমাদের মাঝে নেই। আজ (গতকাল মঙ্গলবার) সকাল ৬টায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’

খালেদা জিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত। খালেদা জিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা এক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। এই দীর্ঘ সময় ‘ব্যাটলিং বেগম’ হিসেবে পরিচিত এ দুই নেত্রীই দেশটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন।

স্বামীর জীবদ্দশায় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে বিএনপির তৎকালীন শীর্ষ নেতারা মনে করেছিলেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ মেটাতে এবং জিয়ার আদর্শ ধরে রাখতে খালেদা জিয়াই একমাত্র ঐক্যবদ্ধ করার মতো ব্যক্তিত্ব।

তবে হাসিনার মতো খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনও অম্লমধুর। দুই নেত্রীই কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। যদিও হাসিনার মতো খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ নেই, তবুও তিনি ছিলেন একজন মেরুকরণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব। বিরোধী দলে থাকাকালে আপসহীন মনোভাব প্রদর্শন, নির্বাচন বর্জন ও দীর্ঘস্থায়ী রাজপথের আন্দোলনে নেতৃত্বদান এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন দুর্নীতির অভিযোগ—সব মিলিয়ে সমর্থকদের কাছে তিনি যেমন অকুতোভয় নেত্রী, তেমনি সমালোচকদের কাছে ছিলেন বিতর্কিত।

উত্থান

খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের দিনাজপুরে (বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল)। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ফেনী জেলার বাসিন্দা। পরিবার নিয়ে দিনাজপুরে স্থায়ী হওয়ার আগে তিনি ভারতের জলপাইগুড়িতে ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসে।

খালেদা জিয়ার শৈশব কেটেছে দিনাজপুরে। সেখানে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন।

রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার অভিষেক কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে হয়নি; বরং হয়েছিল পরিস্থিতির প্রয়োজনে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁর স্বামী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। জিয়ার মৃত্যু দেশকে গভীর অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়। বছরের পর বছর ক্যু আর পাল্টা ক্যুর পর দেশে যে স্থিতিশীলতা জিয়াউর রহমান ফিরিয়ে এনেছিলেন, তাঁর অবর্তমানে তা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠাতা হারানো বিএনপি তখন চরম অস্তিত্ব সংকটে।

খালেদা জিয়া (১৯৪৫–২০২৫)
ছবি: তারেক রহমানের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

স্বামীর জীবদ্দশায় খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে বিএনপির তৎকালীন শীর্ষ নেতারা মনে করেছিলেন, দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদ মেটাতে এবং জিয়ার আদর্শ ধরে রাখতে খালেদা জিয়াই একমাত্র ঐক্যবদ্ধ করার মতো ব্যক্তিত্ব।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন এবং পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করেন; কিন্তু কয়েক মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। একদিকে সামরিক শাসন, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের সেই উত্তাল সময়েই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থানের শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেসামরিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রীতে পরিণত হন।

১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে খালেদা জিয়া বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। পরবর্তী কয়েক দশকে তিনি তিনবার জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এবং তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কয়েক দশক আধিপত্য বজায় রাখেন।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন যেমন ছিল বর্ণিল, তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে তাঁকে অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বড় ছেলে তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন এবং পরে নির্বাসনে যান। ২০১৫ সালে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো প্রবাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় করা দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হয়। পরের বছরগুলোতে রাজনৈতিক একাকিত্ব ও ক্রমাবনতিশীল স্বাস্থ্যের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয় তাঁকে।

তবে খালেদা জিয়ার শাসনামল সমালোচনা থেকেও মুক্ত ছিল না। ১৯৯৫ সালে বোরো মৌসুমের মোক্ষম সময়ে সার মজুত ও বণ্টন অব্যবস্থাপনার কারণে তীব্র সংকট তৈরি হয় এবং দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। প্রতিবাদে হাজারো কৃষক আন্দোলনে নামেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ গুলি চালায়। সংঘর্ষে অন্তত এক ডজন কৃষক ও এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনা গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি এবং সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করে।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নিয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার তাঁর (তারেক রহমান) বিরুদ্ধে মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিলে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছেন তারেক রহমান।

খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমানকে কাছ থেকে দেখা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘তাঁর (খালেদা জিয়া) পুরো জীবনই কষ্টে ভরা। তবুও তিনি ব্যক্তিগত সুখের চেয়ে দেশকেই বড় করে দেখেছেন। এ কারণে সব রাজনৈতিক মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর সময়ের অন্যতম দৃষ্টান্তস্থাপনকারী একজন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।’

ফার্স্ট লেডি থেকে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপির তৎকালীন জ্যেষ্ঠ নেতারা খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার অনুরোধ জানান। যদিও ওই সময় তিনি দলের সাধারণ সদস্যও ছিলেন না।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থান এমন এক সময়ে ঘটেছিল, যখন এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ তুঙ্গে। ক্ষমতা দখলের পর সেনাপ্রধান সংবিধান স্থগিত করে দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন।

আশির দশকজুড়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে যায়।

দিলারা চৌধুরীর মতে, ১৯৮৬ সাল ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বড় মোড়। ওই বছর এরশাদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে বিরোধীরা একে অসাংবিধানিক বলে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, তখনো সামরিক আইন জারি ও রাজনৈতিক অধিকার সংকুচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তা বর্জন করে।

দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘১৯৮৬ সালের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল। আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করে বর্জনের সিদ্ধান্ত তাঁকে নীতির প্রশ্নে আপসহীন একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।’

এরশাদ সরকারের আমলে বারবার গৃহবন্দী হওয়ার ঘটনা এ ধারণাকে আরও মজবুত করে। দিলারা চৌধুরীর ভাষায়, ‘এরশাদকে হটানো এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে খালেদা জিয়া অবিচল ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও জেল-জুলুম সহ্য করার মানসিকতা তাঁকে মানুষের কাছে সম্মানিত করেছিল।’

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের সামরিক সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিএনপি ১৪০টি আসন পায়; যেখানে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৫১টি আসন। আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়ী হয়।

আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত সংসদে বিএনপিকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিলে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন নিশ্চিত হয় খালেদা জিয়ার। দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘এ সমঝোতা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল। এটি খুব সহজে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিও ছিল।’

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ও বেনজির ভুট্টোর মতো দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী নারী নেতৃত্বের সারিতে নাম লেখান।

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্বামী জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করেন খালেদা জিয়া। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১
ছবি: রয়টার্স

শাসনকাল, সংস্কার ও অভিযোগ

খালেদা জিয়া তিন মেয়াদে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রথমবার ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল; পরে ১৯৯৬ সালে সংক্ষিপ্ত দ্বিতীয় মেয়াদে কয়েক মাস এবং সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

১৯৯১ সালের শুরুতে এক বৈঠকের স্মৃতিচারণা করে দিলারা চৌধুরী বলেন, বৈঠক শেষে যাওয়ার সময় খালেদা জিয়া বাড়ির নারীদের সঙ্গে কথা বলতে থামেন এবং জানতে চান, তাঁরা তাঁর কাছে কী প্রত্যাশা করেন।

দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘আমার বড় বোন অধ্যাপক হোসনে আরা খান জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘আমরা চাই, আপনি দেশকে অপেক্ষাকৃত সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত একটি প্রশাসন উপহার দেবেন।’’’

ভুল হোক বা ঠিক, তিনি (খালেদা জিয়া) একবার যা বলতেন, সেখান থেকে সচরাচর পিছু হটতেন না। সমসাময়িক অন্য রাজনীতিকদের মধ্যে এ দৃঢ়তা দেখা যায় না।
মহিউদ্দিন আহমদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত তা দিতে পেরেছিলেন কি না, সেটি একটি জটিল প্রশ্ন বলে মনে করেন দিলারা চৌধুরী। বলেন, ‘স্বামীর জাতীয়তাবাদী দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর এ সদিচ্ছা সত্যিই ছিল। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছেন।’

সমর্থকেরা মনে করেন, দীর্ঘদিনের কঠোর শাসন থেকে বেরিয়ে আসা রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করতে খালেদা জিয়ার সরকার বেশ কিছু কার্যকর নীতি নিয়েছিল। তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক উদারীকরণ, রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধি, শিল্পের পুনরুজ্জীবন, পোশাক খাতের প্রসার ও বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাঁর সময় দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও তুলনামূলক বিকশিত হয়েছিল।

২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ নির্বাচিত মেয়াদের শেষে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৭ শতাংশ। এটি ছিল স্বাধীনতার পর দেশের ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি; যা ৯০-এর দশকের গড় প্রবৃদ্ধি (৪.৮ শতাংশ) ও ৮০-এর দশকের প্রবৃদ্ধির (৩.৮ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি। ওই সময় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অর্থনীতিতে ‘এশিয়ার পরবর্তী উদীয়মান বাঘ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল।

তবে খালেদা জিয়ার শাসনামল সমালোচনা থেকেও মুক্ত ছিল না। ১৯৯৫ সালে বোরো মৌসুমের মোক্ষম সময়ে সার মজুত ও বণ্টন অব্যবস্থাপনার কারণে তীব্র সংকট তৈরি হয় এবং দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। প্রতিবাদে হাজারো কৃষক আন্দোলনে নামেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ গুলি চালায়। সংঘর্ষে অন্তত এক ডজন কৃষক ও এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনা গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি এবং সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষতি করে।

রাজনৈতিক ভুল

দিলারা চৌধুরী এমন দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন; যেখানে খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনের ফল প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছিল। ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে জয়ের জন্য বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে, যা দেশজুড়ে সমালোচিত হয়। পরে ২০০১-০৬ মেয়াদের শেষের দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরবর্তী নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি দলীয় অনুগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বসানোর চেষ্টার অভিযোগ ওঠে।

রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ আরও কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন; যা তাঁর মতে খালেদা জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করেছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় অন্তত ২৪ জন নিহত হন এবং আহত হন কয়েক শ মানুষ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীন পরিচালিত তদন্ত ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। পরবর্তী সময়ে তদন্তকারীরা এ হামলার জন্য উগ্রবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করেছিলেন।

২০১৮ সালে ঢাকার একটি আদালত এ হামলার ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে দণ্ড দেন। তবে সম্প্রতি আপিল ও হাইকোর্টের রায়ে কয়েকজনের সাজা বাতিল এবং কয়েকজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ হামলার বিচার ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক বাংলাদেশির কাছে আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালের এপ্রিলে। পুলিশ ও কোস্টগার্ড অবৈধ অস্ত্রের একটি বিশাল চালান আটক করে; যা ভারতের আসামের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফার জন্য আনা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

মহিউদ্দিন আহমদ আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ঘটনাগুলো দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক শত্রুতা গভীর ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করেছিল।’

২০০১-০৬ মেয়াদে খালেদা জিয়া সরকারের নেওয়া কিছু ভুল পদক্ষেপ রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করে। এর চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত ক্ষমতা দখল (ওয়ান-ইলেভেন)। সে সময় সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ এবং ওই মাসের শেষ দিকে নির্ধারিত নির্বাচন বাতিলে চাপ দেয়। সেনাবাহিনীর সমর্থনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে নতুন অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানো ও নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়াই ছিল এ সরকারের কাজ।

এ পরিবর্তনের ফলে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা—উভয়কেই প্রায় দুই বছর সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হয়।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তাঁর (খালেদা জিয়া) দলই এমন পরিস্থিতি (ওয়ান-ইলেভেন) তৈরি করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত দল ও তাঁর পরিবারই এর শিকারে পরিণত হয়।’

আরও পড়ুন

‘গণতন্ত্রের প্রতি আপসহীন’

খালেদা জিয়ার সরকারের একজন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সমঝোতা করার জন্য প্রচণ্ড চাপের মুখেও তাঁর নেত্রী কখনো রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হননি।

আমীর খসরু বলেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর (খালেদা জিয়া) অঙ্গীকার ও দেশপ্রেম নেতা-কর্মীদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ওয়ান-ইলেভেন এবং পরে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিএনপিকে ভেঙে দেওয়ার বারবার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু তাঁর আদর্শই দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘গত কয়েক দশকে রাজনীতি থেকে অনেকেই লাভবান হয়েছেন। কিন্তু খালেদা জিয়াকে বিশাল মূল্য দিতে হয়েছে, বিশেষ করে ২০০৬ সালের পর থেকে।’ এর মাধ্যমে তিনি খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের ওপর আসা কারাবরণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নিরবচ্ছিন্ন চাপের প্রতি ইঙ্গিত করেন।

ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
ছবি: রয়টার্স

এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থানের কথা উল্লেখ করে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ভুল হোক বা ঠিক, তিনি একবার যা বলতেন, সেখান থেকে সচরাচর পিছু হটতেন না। সমসাময়িক অন্য রাজনীতিকদের মধ্যে এ দৃঢ়তা দেখা যায় না।’

একটি রক্ষণশীল সমাজে যেখানে নারীর নেতৃত্ব নিয়ে একসময় সংশয় ছিল; সেখানে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বড় অংশ হয়ে থাকবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ওয়ান-ইলেভেনের পর বড় ছেলেকে (তারেক) নির্বাসনে যেতে হলেও কিংবা হাসিনা সরকারের আমলে চরম প্রতিহিংসার শিকার হয়েও দেশ ছেড়ে না যাওয়ার (খালেদা জিয়ার) সিদ্ধান্ত বিএনপিকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তিনি চাইলে বিদেশে চলে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি থেকে যাওয়ার ও পরিণাম ভোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ সংকল্পই তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।’

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরও মনে করেন, খালেদা জিয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ক্ষেত্রেও সংযত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ প্রচারণা ও গালাগাল করা হলেও তিনি কখনো একই ভাষায় পাল্টা জবাব দেননি।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যটি ছিল এর বড় উদাহরণ।

৬ আগস্ট গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পর খালেদা জিয়া সমর্থকদের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ না হওয়ার আহ্বান জানান। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘অনেকের কাছেই এটি ছিল অকল্পনীয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে থাকার পরও তিনি কোনো উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করেননি।’

তবে এখন একটি বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, খালেদা-পরবর্তী যুগে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্নের জবাবের কেন্দ্রে রয়েছেন তাঁর ছেলে তারেক রহমান।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলে পরিণত হয়েছে। তারেক রহমানের নেতৃত্ব এখনো চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হয়নি। তাই বিএনপি বড় ধরনের নেতৃত্ব সংকটে পড়তে পারে।’

আগামী জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের ছুটিতে দেশে ফিরেছেন তারেক রহমান। বিমানবন্দরে দলীয় নেতা-কর্মীদের ঢল নামে। এবারের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে তাদের সাবেক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

দেশে ফেরার পর নিজের প্রথম বক্তব্যে তারেক রহমান একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, ৬০ বছর বয়সী এ নেতা ভারতের সঙ্গে ঝুলে থাকা সম্পর্কেরও উন্নতি করতে পারেন। হাসিনার অপসারণ ও দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অতীতে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ না থাকলেও, সম্প্রতি দুই পক্ষ থেকেই ইতিবাচক সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।

এখন বিএনপি ও তারেক রহমানের সামনে বড় পরীক্ষা। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শুধু এটিই ঠিক করবে না যে কে বাংলাদেশের পরবর্তী নেতা হচ্ছেন; বরং এটিও স্পষ্ট করতে পারে যে দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার উত্তরসূরির ওপর কতটা আস্থা রাখছে।

আরও পড়ুন