রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় ইমিটেশনের গয়না তৈরির একটি কারখানায় ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরী কাজ করে। সরকার জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়া শুরুর পর ওই কিশোরীকে টিকা দিতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়েন টিকাদানকারীরা। মেয়েটির পরিবারের প্রশ্ন, ‘টিকা দিয়া কি হইব?’
অনেক বোঝানোর পর মেয়েটির মা–বাবা জানান, মেয়ে কারখানা থেকে ছুটি নিয়ে এসে টিকা নিতে পারবে না। গত ১৩ নভেম্বর কারখানার দুপুরের খাবারের বিরতিতে ওই কিশোরীকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন টিকাদানকারীরা।
আবার কোনো কোনো মা–বাবা বলেছেন, তাঁরা টিকার বিষয়ে জানতেন না। টিকা নিলে কী উপকার হয়, সেটাও তাঁদের অজানা।
জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে গত ২ অক্টোবর থেকে সরকার বিনা মূল্যে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের এক ডোজ করে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা দেওয়া শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) এই টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিশোরীরা স্কুল ও ইপিআইয়ের টিকাকেন্দ্রগুলো থেকে টিকা নিতে পারছে।
দেশের এক কোটির বেশি কিশোরীকে এ টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য সরকারের। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) প্রথম দফায় বাংলাদেশকে ২৩ লাখ টিকা দিয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ঢাকা বিভাগে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে না, এমন ঝরে পড়া, গৃহকর্মী ও শ্রমজীবী কিশোরীরাও এ কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। এই কিশোরীদের টিকা দিতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে টিকাদানকারীদের। কার্যক্রম শুরুর ১ মাস ২৬ দিন পরও ওই কিশোরীদের টিকা দেওয়ার হার কম। শুরুতে অনলাইনে জন্মনিবন্ধন দিয়ে আবেদন করার ব্যবস্থা থাকা ও সচতেনতামূলক প্রচার কম থাকায় টিকা দেওয়ার হার কম।
জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে গত ২ অক্টোবর থেকে সরকার বিনা মূল্যে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের এক ডোজ করে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) টিকা দেওয়া শুরু করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) এই টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিশোরীরা স্কুল ও ইপিআইয়ের টিকাদান কেন্দ্রগুলো থেকে টিকা নিতে পারছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির সর্বশেষ ২০২০ সালের গ্লোবোক্যান প্রতিবেদন অনুসারে, জরায়ুমুখের ক্যানসারে আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বছরে নতুন করে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২৬৮ জন। আর বছরে মারা যান ৪ হাজার ৯৭১ জন।
‘টিকার খবর জানতাম না’
মোহাম্মদপুরের চন্দ্রিমা উদ্যানের বাসিন্দা হালিমা (১৪) চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার পর স্কুলে পড়া ছেড়ে দেয়। পরে মায়ের সঙ্গে গৃহকর্মীর কাজে যুক্ত হয়। গত ২২ নভেম্বর সে টিকা নিয়েছে। টিকা নেওয়ার নিবন্ধনের জায়গায় সামিয়া আক্তার নামের একজন নারীর মুঠোফোন নম্বর দেওয়া। কল করলে সামিয়া আক্তার বলেন, তিনি কিশোর-কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কিছু কাজে যুক্ত আছেন। হালিমা তাঁর পরিচিত। দরিদ্র মা–বাবা সচেতন না হওয়ায় টিকার বিষয়ে আগ্রহী হননি। তবে উপকারিতা বোঝানোর পর তাঁরা মেয়েকে টিকা নিতে পাঠিয়েছেন।
মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের বাসিন্দা ভ্যানচালক মো. সবুজ ও ‘ছুটা বুয়া’ শিরিনা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় সুমি (১২)। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর দুই বছর ধরে সে স্কুলে যায় না। বাসায় ছোট ছোট দুই বোনকে দেখভাল করে।
মা শিরিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকার খবর জানতাম না, তাই মেয়েরে টিকা দিতে নিয়া যাই নাই।’ দু-তিন আগে এক প্রতিবেশী জানান, তাঁর স্কুলপড়ুয়া মেয়ে টিকা পেয়েছে। ওই প্রতিবেশীর মাধ্যমে খবর পেয়ে টিকাদানকর্মীরা সুমিসহ পাশাপাশি বাসার স্কুল থেকে ঝরে পড়া আরও দুই কিশোরী হাসনা ও নূপুরকে গত ২৭ নভেম্বর টিকা দেন।
রাজধানীতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো টিকাদানকারীদের মাধ্যমে এ টিকা দিচ্ছে। এ কাজে সিটি করপোরেশনগুলো বেসরকারি সংস্থাদের যুক্ত করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল–৫-এর আওতায় ৯টি ওয়ার্ড রয়েছে (২৬ থেকে ৩৪)। এর মধ্যে ৫টি ওয়ার্ডে এইচপিভি টিকা দেওয়ার কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রী।
গত ২২ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী এলাকায় (৩৩ নম্বর ওয়ার্ড) নগর মাতৃসদনকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার কিশোরীদের এইচপিভি টিকা দেওয়ার কার্যকলাপ সেখান থেকে সমন্বয় করা হয়। ওই কেন্দ্রেও টিকা দেওয়া হয়। তবে ঝরে পড়া বা শ্রমজীবী কিশোরী কাউকে ওই দিন টিকা নিতে আসতে দেখা যায়নি। ওই কেন্দ্রে ১৫ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৫৮২ কিশোরীকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঝরে পড়া ও শ্রমজীবী কিশোরী মাত্র ২৬ জন।
রাজধানীতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো টিকাদানকারীদের মাধ্যমে এ টিকা দিচ্ছে। এ কাজে সিটি করপোরেশনগুলো বেসরকারি সংস্থাদের যুক্ত করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল ৫-এর আওতায় ৯টি ওয়ার্ড রয়েছে (২৬ থেকে ৩৪)। এর মধ্যে ৫টি ওয়ার্ডে এইচপিভি টিকা দেওয়ার কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা নারী মৈত্রী।
কেন্দ্রে নারী মৈত্রীর মাঠ পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সহজে টিকা দেওয়া যাচ্ছে। তবে ঝরে পড়া কিশোরী বা শ্রমজীবীদের অনেকে নিজে থেকে আসছে না। শুরুতে নেতিবাচক মনোভাবও ছিল। বিশেষ করে পরিবারের বয়স্ক নারীরা বলছিলেন, ‘টিকা দিয়ে কী হবে, আমরা তো টিকা দিইনি, কিছুই তো হয়নি।’ এখন সেই মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে।
জহিরুল ইসলাম আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে টিকা দেওয়ার সময় বলা হচ্ছে, কারও নজরে এ ধরনের কিশোরী থাকলে যেন তাঁরা টিকাদানকারীদের জানান। বাসার কিশোরী গৃহকর্মী থাকলে যেন পাঠান। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর বসবাসের জায়গায় টিকা দেওয়ার অস্থায়ী ক্যাম্পও করা হয়েছে।
ইপিআইয়ের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এস এম আবদুল্লাহ আল মুরাদ প্রথম আলোকে জানান, গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৪১৮ কিশোরীকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কমিউনিটির (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া, শ্রমজীবী) কিশোরী ৭৮ হাজার ৫২ জন। ওই সময় পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে।
আবদুল্লাহ আল মুরাদ আরও বলেন, টিকা দেওয়ার দায়িত্ব যাঁরা পালন করছেন, তাঁদের নজর রাখতে বলা হয়েছে, যেন কমিউনিটির কিশোরীরা বাদ না পড়ে।
শর্ত শিথিল হওয়ায় এখন কমিউনিটির শিশুদের টিকা নেওয়ার হার আগের চেয়ে বেড়েছে।এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম, সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫
শর্ত শিথিল
ঝরে পড়া, শ্রমজীবীসহ বেশিসংখ্যক কিশোরীকে টিকার আওতায় আনতে টিকা দেওয়ার শর্তও শিথিল করা হয়েছে। যেমন জন্মনিবন্ধন না থাকলে বা অনলাইনে টিকার জন্য নিবন্ধন না করলেও টিকা দেওয়া হয়েছে। সময় বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। গত ১৬ নভেম্বর ঢাকায় টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে তা ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এই সময়সীমার পরও টিকা দেওয়া হচ্ছে।
উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫–এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শর্ত শিথিল হওয়ায় এখন কমিউনিটির শিশুদের টিকা নেওয়ার হার আগের চেয়ে বেড়েছে।