প্রথম আলো :
বই তো আপনার বহু আগে থেকেই বের হয়। কিন্তু আজ জন্মদিনে রচনাবলি হাতে পেয়ে কেমন লাগল?
আহমদ রফিক: মনটা ভরে গেল। বই বের হওয়া লেখকের জন্য খুব আনন্দের, উপভোগের। ১৯৫৮ সালে আমার প্রথম বই যখন বের হলো, কী ভালোটাই না লেগেছিল। ‘শিল্প ও সংস্কৃতিজীবন’—এটার মধ্যে কতগুলো খুব ভালো প্রবন্ধ ছিল। স্থানীয় লেখকদের ওপরও কিছু লেখা ছিল। প্রথম প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘কাব্যের সপক্ষে’। শেলির একটি প্রবন্ধ আছে ‘ইন ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’। সেটার অনুসরণে আমার মতো করে লেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স লিস্টে বইটা ছিল। এটা একজন লেখকের জন্য যথেষ্ট আনন্দের বিষয়। এরপর তো বইয়ের পর বই বেরিয়েছে। আমাকে কোনো প্রকাশকের কাছে ধরনা দিতে হয়নি। প্রথম বই থেকেই তারা নিজেরাই এসে আমার কাছে বই নিয়েছে। সেই থেকে বছরের পর বছর তিনটে-চারটে করে বই বেরিয়েছে আমার। সর্বশেষ বেরিয়েছে আমার আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসধর্মী বই ‘দুই মৃত্যুর মাঝখানে নান্দনিক একাকিত্বে’। আমার জীবনটা যে ট্র্যাজিক একাকিত্বের জীবন, সেটার কিছু আভাস-ইঙ্গিত সেখানে আছে। এই সময় নামে একটি প্রকাশনী বের করেছে।
প্রথম আলো :
জীবনটাকে ট্র্যাজিক বলছেন কেন?
আহমদ রফিক: আমার জীবনটা ছোট ছোট খণ্ড খণ্ড ট্র্যাজেডিতে ভরা।
প্রথম আলো :
একটা ঘটনার কথা বলবেন?
আহমদ রফিক: আমার স্ত্রীর মৃত্যু। অ্যাস্ট্রোসাইটোমা গ্রেড ফোর, ব্রেন ক্যানসারে সে মারা গেছে। ও তো আমার তিন বছরের ছোট, ওর এত আগে যাওয়া উচিত হয়নি। এ ছাড়া ট্র্যাজেডির নানা রকমের রূপ থাকে। আপাতদৃষ্টিতে সবাই মনে করে আমি বুঝি দারুণ একটা দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছি। আমার বন্ধু রইস উদ্দিন ভূইয়া। কিছুদিন আগে মারা গেছে। ‘জনান্তিক’ নামে একটা পত্রিকার সম্পাদক ছিল। সে বলত, ‘রফিক ভাই, কী একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন, ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবন।’ আমি তো জানি, ৫০ বছরের দাম্পত্য জীবনে কত টিটবিটস। এর বেশি বলা যায় না, বলা উচিতও না। কোনো মানুষই নিজের জীবনকে নিয়ে পুরোপুরি সন্তুস্ট না, হওয়ার কথাও না। প্রত্যেকেরই যে আকাঙ্ক্ষা, সে আকাঙ্ক্ষার বাইরে তার জীবনযাপন। সে আকাঙ্ক্ষা কখনো পুরোপুরি পূর্ণ হয় না। আদর্শ বলেন, ব্যক্তিজীবন বলেন, সব ক্ষেত্রে কিন্তু এটা সত্য। সেই সত্যটাকে যদি আমরা মানি, দেখা যাবে কোনো মানুষই পরিপূর্ণভাবে সফল জীবন যাপন করে না। আপাতদৃষ্টে বাইরে থেকে দেখা গেলেও, আমি তো খুশি না। আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষ একাকিত্বের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, কমবেশি। আপনি নিজের দিকে তাকালে দেখবেন, আপনি সবার সঙ্গে আছেন, আবার নেই।
প্রথম আলো :
সৃষ্টিশীল মানুষের ক্ষেত্রে এটি আরও বড় সত্য, তাই না?
আহমদ রফিক: আরও গভীর। আরও বেদনাদায়ক অনেক সময়। আমি যা চাইলাম, পেলাম না। বছরের পর বছর যে সাধনা করলাম, সেটা আমার হাতে ধরা দিল না। তা–ই যদি হয়, তাহলে একটা মানুষ সর্বাঙ্গে সুখী হতে পারে? কখনো না। এটাই ট্র্যাজেডি।
প্রথম আলো :
এটা তো ব্যক্তিজীবনের কথা বললেন। আর লেখকজীবন?
আহমদ রফিক: লেখকজীবনে আমার অনেক আনন্দ। অনেক উপভোগ, অনেক শান্তি ও স্বস্তি। লেখকজীবন যদি না থাকত, যদি এই জীবনটা বেছে না নিতাম, রাজনীতিতে থেকে যেতাম, ভুল করতাম। আমি শেষ দিকে রাজনীতিতে ডুবে ছিলাম। যে জন্য আমার মেরিটোরিয়াস ক্যারিয়ার নষ্ট হলো। এরপর চিন্তার করলাম, রাজনীতি করব নাকি সাহিত্য করব। আমি দ্বিতীয়টা বেছে নিলাম। রাজনীতি ছেড়ে দিলাম, দলীয় রাজনীতি। ভুল করবেন না, ‘দলীয় রাজনীতি’। রাজনীতি ছাড়া তো মানুষ হয় না। এখনো মনে করি, আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ, সাহিত্যভুবন আমাকে যা দিয়েছে, রাজনীতি আমাকে দিতে পারত না। কখনোই না।
প্রথম আলো :
যত দিন রাজনীতি করেছেন, একজন রাজনীতিক বা রাষ্ট্রের একজন অভিভাবক হিসেবে আমাদের আজকের রাষ্ট্রীয় জীবনকে কীভাবে দেখেন?
আহমদ রফিক: আমরা রাজনৈতিকভাবে যা চেয়েছি, সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। আমরা সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারিনি। একটা শ্রেণিকে আমরা সমৃদ্ধ করেছি, ইংরেজিতে যাকে বলে ভার্টিক্যাল গ্রোথ। এই গ্রোথ হয়েছে উচ্চবিত্ত শ্রেণি, মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের। এরাই সমস্ত ক্রিম, মধু খেয়ে নিয়েছে। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষ অবহেলিত। তারা খুব সামান্য পেয়েছে, হয়তো পায়নি।
প্রথম আলো :
আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, সেখানে পৌঁছানোর উপায় তাহলে কী? ছোট ছোট কোনো জায়গা আছে, যেগুলো ঠিকঠাক করলে আমরা কিছুটা এগোতে পারব?
আহমদ রফিক: আমি বরাবর বলি, একটা আদর্শকে ধরে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। সমাজতন্ত্রের পতনের পর আমি অনেক ভেবেছি। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে, হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদকে যদি আমরা আঁকড়ে ধরি, তাহলে সেটার মাধ্যমে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ-মতাদর্শও কিন্তু হিউম্যানিজমের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ নামে সেক্যুলার, আসলে কি সেক্যুলার? একের পর এক সংখ্যালঘু শ্রেণির ওপর বিশেষ করে নিম্নবিত্তের ওপর হামলা চলে। এটার ভেতরে বহু ফ্যাক্টর এসে যোগ দেয়। আমাদের সরকার চুপ করে দেখে। হামলার শিকার যারা, তাদের বরাত দিয়ে যদি বলি, তারা বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সময়মতো আসত, তাহলে এত ঘর পুড়ত না। তার মানে এসব ব্যাপারে উদাসীনতা আছে।
প্রথম আলো :
আপনারা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন। বাংলা ভাষাটা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। বাঙালি সেখানে বসে বাংলা গানের চর্চা করছে, বাংলা সিনেমা দেখছে। বিশ্বময় বাংলা ভাষার এই প্রসারে আপনি কতটা তৃপ্ত?
আহমদ রফিক: একেবারেই তৃপ্ত নই। আমি বহুবার বলেছি, আবারও বলছি—বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আমাদের তিনটি প্রধান স্লোগান ছিল। এক, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই; দুই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই; তিন, সর্বস্তরে বাংলা চালু করো। চালু হয়েছে? উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা ও উচ্চ আদালত—কোথাও বাংলা নাই। এক অনুষ্ঠানে কামাল হোসেনের সঙ্গে কাজ করেছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে বলুন, বাংলা ভাষা দিয়ে আইন-আদালত চলতে পারে? তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘চলতে পারে। তবে সেটা শ্রমসাপেক্ষ।’ আগের যত রেকর্ডস, সবগুলোকে বাংলায় ট্রান্সলেট করতে হবে। এটা বিরাট কাজ। আসলে সদিচ্ছা দরকার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা ওই স্লোগানগুলো, ওই আদর্শগুলো ভুলে গেলাম। ঔপনিবেশিক ভাষা ইংরেজিকে আঁকড়ে ধরলাম। ইংরেজিকে আমি বাদ দিতে বলি না। বলেছি, ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করো, কিন্তু বাংলা প্রথম ভাষা। মাতৃভাষা প্রথম ভাষা। এটা পৃথিবীর সব জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে আছে। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর কথা যদি বলি, যেমন ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলোর রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে যুক্ত তাদের সবকিছু। শুধু বাংলাদেশ একটা বিচিত্র অবস্থানে রয়েছে।
প্রথম আলো :
জন্মদিনের এই আয়োজন কেমন লাগে?
আহমদ রফিক: আমি কখনো জন্মদিন পালন করিনি। কবে যেন আমার কিছু শুভানুধ্যায়ী জন্মদিন উদ্যাপন শুরু করে দিল, প্রকাশকেরা সুযোগ পেয়ে গেল। সময়, অন্যপ্রকাশের মাজহার—এরা কেক-টেক নিয়ে হাজির হলো। আগে শুনতাম, জন্মদিনে মা-দিদিমায়েরা পায়েস রান্না করত। কেক তো বিদেশি সংস্কৃতি। কেক আমি পছন্দ করি না। বললাম, কেক এনেছেন কেন? আপনি যদি এক বাটি পায়েস আনতেন, আমি বেশি খুশি হতাম। তারা একটু লজ্জা পেল। বললাম, ঠিক আছে, এনেছেন যখন একটু মুখে দিই।
প্রথম আলো :
কিন্তু এই আয়োজনটা কি আপনার ভালো লাগে না?
আহমদ রফিক: অবশ্যই। সেটা স্বীকার না করলে ভুল হবে, অন্যায় হবে, আত্মপ্রতারণা হবে। এটা আমি অস্বীকার করি না।
প্রথম আলো :
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
আহমদ রফিক : মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভালো করে শেখো, ভালো করে পড়ো, নির্ভুলভাবে বলতে শেখো। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভালো করে শেখো, পড়ো, বলতে শেখো।