প্রয়োজন তাঁকে আগলে রাখা

আহমদ রফিক

‘হে বসুধা,/ নিত্য নিত্য বুঝায়ে দিতেছ মোরে—যে তৃষ্ণা, যে ক্ষুধা/ তোমার সংসাররথে সহস্রের সাথে বাঁধি মোরে.../ ফিরায়ে নিতেছ শক্তি, হে কৃপণা, চক্ষুকর্ণ থেকে/ আড়াল করিছ স্বচ্ছ আলো; দিনে দিনে টানিছে কে/ নিষ্প্রভ নেপথ্যপানে।’ জীবনাবসানের মাত্র তিন বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে জীবনসত্যকে কবিতায় ধরেছিলেন, তাকে যেকোনো সৃষ্টিশীল ব্যক্তির জীবনপ্রান্তের এক চিরন্তন উপলব্ধি হিসেবে গণ্য করা যায়।

ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক যেন অভিন্ন এক জীবনোপলব্ধির মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন। সাম্যবাদী চেতনাসম্পন্ন পূর্ণকালীন লেখকজীবন কাটানো মানুষটির চক্ষুকর্ণের স্বাভাবিক শক্তি অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত। শরীরে নেই হাঁটাচলার ছন্দ। যা আছে, তা হলো প্রখর ধীশক্তি, সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতিকে চুলচেরা বিশ্লেষণের নিখুঁত দক্ষতা, অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যৎকে দেখার নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি।

ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া আহমদ রফিক প্রথমা প্রকাশন

ভাষা আন্দোলন সংগঠনে আপসহীন ভূমিকার কারণে বিপর্যস্ত হয়েছিল তাঁর শিক্ষাজীবন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র আহমদ রফিক স্নাতক সম্পন্ন করলেও নিষেধাজ্ঞার কারণে চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেননি। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষের জন্য, ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য। যে স্বপ্ন-সংগ্রাম তাঁরা শুরু করেছিলেন আটচল্লিশ থেকে, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তা অসাম্প্রদায়িক জাতিগঠন ও স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সেই সংগ্রামের দর্শনকে লালন করে তিনি ভাষামাধ্যমে সৃষ্টিশীল থেকেছেন। শতাধিক গ্রন্থপ্রণয়নের বিরল কৃতিত্ব তো সেই সংগ্রামশীল প্রতিচ্ছবিকেই সামনে আনে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ২০১৮ সালে এক বক্তৃতায় তাঁকে নিয়ে বলেছিলেন, চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করে কেবল রাজনৈতিক কারণে চিকিৎসক হতে না পারলেও বিচিত্র বিষয়ে প্রয়োজনীয় লেখালেখির মধ্য দিয়ে আহমদ রফিক প্রতিনিয়ত সমাজের চিকিৎসা করে গেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে নির্মোহ গ্রন্থপ্রণয়ন, স্বাধীনতা আন্দোলনের তথ্যভিত্তিক গবেষণা, নজরুল, জীবনানন্দ, চে গুয়েভারা, বাংলাদেশের কবিতা-বিষয়ক অনন্য আলোচনা, শহীদ বুদ্ধিজীবী ও কালোত্তীর্ণ মানুষদের নিয়ে নিজস্ব মূল্যায়ন তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় করে রাখবে।

তবে অতি সম্প্রতি সামনাসামনি আলাপকালে আহমদ রফিক আক্ষেপ প্রকাশ করলেন। বললেন, যে জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন, তা অধরাই থেকে গেছে। একুশের চেতনাকে ঘিরে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জাগরণ সাফল্য এনে দিয়েছিল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। সেই রাষ্ট্রে বাংলা সর্বস্তরের মানুষের ভাষা হলো না, বরং উপেক্ষিত হলো।

আরও পড়ুন
রুশ বিপ্লব: স্তালিন–বিতর্ক ও রবীন্দ্রনাথ আহমদ রফিক প্রথমা প্রকাশন

সেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের ভাষা বাংলাকে নিয়ে এখন আর কেউ স্বপ্ন দেখে না, মাতৃভাষা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হোক, জীবিকার অবলম্বন হোক, সেটা এখন আর কেউ উপলব্ধি করে না। তিনি মনে করেন, বিপুল সম্ভাবনাময় অতীতের স্বপ্নগুলোর বেশির ভাগই রয়ে গেছে অধরা।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মানসিকভাবে সাম্প্রদায়িক। এদের অসহিষ্ণুতা নিয়ে তিনি বললেন, শুধু আমাদের দেশ নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলগুলোর রাজনীতি কখনোই শতভাগ প্রগতিশীল ছিল না—আপাতভাবে প্রগতিশীল ছিল। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বললেন, নবীন জাতিরাষ্ট্রগুলোর দুর্বলতা হলো, এসব দেশের জনগণ আন্দোলনে একরকম, ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে আরেকরকম। তখন উন্নতিকে খেয়ে ফেলে দুর্নীতি।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যর্থতার সুযোগে দুর্নীতির ফাঁক দিয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে ফেলে। আর যারা প্রগতিশীল রাজনীতি করেছে, তাদের কথা জনগণ আস্থায় নিতে পারেনি। আবার মুক্তিযুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়লাভ করলেও তাদের পরাভূত করা যায়নি। পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডির পর তারা পুনর্জন্ম লাভ করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঘাটতির মূলে তারাই।

আরও পড়ুন

আহমদ রফিকের সাহিত্যচর্চার মূলে কাজ করেছে মার্ক্সবাদী চেতনা। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন আর দেখতে চান না তিনি। সমাজতন্ত্র ব্যর্থ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও মানবকল্যাণ সুদূরপরাহত। এর বিকল্প কী? তাঁর ভাষ্য, একমাত্র মানবতাবাদই পারে সব ধরনের সমস্যা উত্তরণে সঠিক ভূমিকা রাখতে।

অন্ধ জাতীয়তাবাদ কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মানুসারীদের অহমিকা একই সমাজে বসবাস করা অন্যদের ‘অপর’ করে দেয়। ফলে তাতে দেখা দেয় মানবিকতার সংকট। যদি দেশ পরিচালনায় নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মানবিকতার চর্চা না হয়, তবে কী করে সম্ভব মানবিক সমাজ গঠন? তাঁর স্পষ্ট উত্তর, ব্যক্তি থেকে সংঘ, সংঘ থেকে প্রতিষ্ঠানের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে মানবতাবাদী দর্শন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে—যেমন করে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সংস্কৃতিকর্মী ও ছাত্ররাই পথ দেখিয়েছে মূলধারার রাজনীতিকে।

গত এক বছর ক্রমশ অবনতিশীল স্বাস্থ্যের কারণে বেশ কবার থাকতে হয়েছে হাসপাতালে। ক্ষীণদৃষ্টির কারণে লিখতে পারেন না কিছুই।
তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে শেষদিককার পাণ্ডুলিপিসমূহ। এর মধ্যে রয়েছে আত্মজীবনী—দুই মৃত্যুর মাঝখানে নান্দনিক একাকীত্বে, স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ বিচ্ছিন্ন ভাবনা এবং গবেষণাগ্রন্থ নবজাগরণের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগর

এই ঘোর অসময়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ‘যেকোনো প্রয়োজনে পাশে থাকার’ আশ্বাস পেয়ে তিনি আনন্দিত। তাঁরই আগ্রহে বাংলা একাডেমি আহমদ রফিকের রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁর সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক যত্ন—তাঁর পাশে থাকা, তাঁকে আগলে রাখা।

রাষ্ট্রের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া উপার্জনহীন, নিকটতম স্বজনহীন একজন ব্যক্তির পক্ষে তা কোনোভাবেই সম্ভব না। এত সংকট সত্ত্বেও তিনি যেন আশাহত হয়ে বলতে চান না, ‘মিছে আজ স্বপ্ন দেখা চারিপাশে উদ্ধত নায়ক/ রক্তের গভীরে ক্লেদ জমা রেখে সেজেছে সম্রাট,.../ মূঢ় ক্লীব জনপদে নির্বাসিত স্বপ্নের আকাশ/ নিসর্গ আবেগ প্রেম নির্জনতা পোশাকি বিলাস।’

আহমদ রফিক, জন্মদিনে আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

ইসমাইল সাদী, শিক্ষক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়