অন্য এক আহমদ রফিক

ছবি: প্রথম আলো

রবীন্দ্রভুবনে পতিসর, ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কিংবা দেশবিভাগ: ফিরে দেখার মতো বইয়ের লেখক আহমদ রফিক যে কেমন আছেন, ঔষধ-চিকিৎসা-সেবা বৈষম্যের শিকার সাধারণ মানুষ, ফিট থাকুন দেহেমনে-এর মতো স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত কয়েকটি বইয়েরও লেখক, তা হয়তো অনেকেরই অজ্ঞাত।

চিকিৎসাশাস্ত্রে আহমদ রফিকের প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়নের স্মারক ধরা আছে স্মৃতিবিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ বইসহ ডেভিনসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান পরিভাষা কোষ–এর শ্রমসাধ্য অনুবাদ, সংকলন ও সম্পাদনাকর্মে। বাংলা একাডেমির এ উদ্যোগে তাঁর বিশিষ্ট সহযোগী ছিলেন সদ্য প্রয়াত, আহমদ রফিকের মতোই আরেক ভাষাসংগ্রামী ডা. সাঈদ হায়দার। সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের যে চেতনা থেকে তাঁরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন মূলত তারই ধারাবাহিকতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের জটিল ক্ষেত্রে বাংলা প্রবর্তনের কাজে যুক্ত হয়েছিল তাঁদের অনন্য অঙ্গীকার।

ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক
প্রথমা প্রকাশন

আহমদ রফিকের শিক্ষা, পেশা আর নেশা অল্প কথায় যথার্থ ব্যাখ্যাত হয়েছে আনিসুজ্জামানের লেখায়—‘ডাক্তারি পাস করলেও তিনি চিকিৎসা পেশায় যাননি, একটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেননি, তবে মার্ক্সবাদে তাঁর আস্থা রয়ে গেছে অবিচল এবং তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মেও মার্ক্সবাদী চেতনার প্রতিফলন আছে। অন্যদিকে সাহিত্যকর্ম শুধু ধরেই রাখেননি, এটিই হয়ে দাঁড়ায় তাঁর সর্বক্ষণের কাজ।’

ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ আহমদ রফিকের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন এবং এ আন্দোলন ১৯৫২-তেই সমাপ্ত বলে মানেন না তিনি। সে জন্যই ভাষা আন্দোলনের যোদ্ধাদের ‘ভাষাসৈনিক’ না বলে ‘ভাষাসংগ্রামী’ সম্বোধনের প্রস্তাব ছিল তাঁরই। তাঁর মতো ‘সৈনিক’–এর কার্যপরিধি তো শুধু যুদ্ধকালীন আর ‘সংগ্রামী’র কার্যসীমা অনন্তকালীন। ভাষা আন্দোলনের বীজপর্ব থেকে তিনি নিজেও সে সংগ্রামে এখনো নিবিষ্ট। একুশের মিছিল-সভায় দৃপ্ত উপস্থিতি, শহীদের রক্তের আভা, রাতজাগা শ্রম ও সংকল্পে মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে যুক্ততার পথরেখায় ভাষা আন্দোলন বিষয়ে কুড়িটি বই লেখা তো বহমান এক ভাষাসংগ্রাম। ঢাকা মেডিকেলের অ্যানাটমি বিভাগে ‘ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম’ প্রতিষ্ঠা, ১৯৮৩ সালে মেডিকেলের সতীর্থদের নিয়ে ‘একুশে পরিষদ’ গঠন এবং ২০১০ সালে একে বিস্তৃত পরিসরে ‘একুশে চেতনা পরিষদ’-এ রূপান্তর এবং একুশের স্মরণীয় সিদ্ধান্তের সময়ক্ষণ উদ্‌যাপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন তাঁকে এক অক্লান্ত ভাষাসংগ্রামীর মহিমা দেয় অনায়াসে। বায়ান্নর বন্ধু আবদুল গাফফার চৌধুরীর সংগত মূল্যায়ন—‘আহমদ রফিকের সবচাইতে বড় অবদান ভাষাসংগ্রাম সংগঠনে এবং তার সঠিক ইতিহাস প্রণয়নে।’

গ্রামবাংলার পথে পথে ঘুরেছেন তিনি নিরন্তর; সাহিত্যিকের নিবিড় অবলোকনে পল্লিপ্রকৃতিই মুগ্ধতায় ধরা দেয়নি শুধু, পাশাপাশি গ্রামীণ দারিদ্র্যের অবসানকল্পে ব্রতী করেছে ‘গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা’ গঠনে।

ভাষা আন্দোলন: টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, আহমদ রফিক
প্রথমা প্রকাশন

আবার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র বিষয় নিয়েও কুড়িটির মতো বই লেখাই তাঁর রবীন্দ্রচর্চার পরিধি নয়; ‘রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা, দেশে ও বিদেশে রবীন্দ্রবিষয়ক সেমিনার আয়োজন, রবীন্দ্রবিষয়ক সাময়িকপত্র প্রকাশের সমান্তরালে মৃত্তিকার রবীন্দ্রনাথকে তিনি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন এই বাংলার ঢাকা থেকে নওগাঁয়। রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত ঢাকার লালকুঠিতে স্মারকফলক স্থাপন কিংবা ১৯৯০-৯৫ কালপর্বে নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্রভূমি অধিগ্রহণ, কুঠিবাড়ি উদ্ধার ও সংরক্ষণে তাঁর উদ্যম ও প্রয়াস অবিস্মরণীয়।

নিজে রবীন্দ্র-গবেষক; উত্তরপ্রজন্মের মধ্যেও যেন এ বিষয়ে গবেষক-আগ্রহ তৈরি হয় এবং প্রণোদনা সহজতর হয়, সে জন্য ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’–এর প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চালু করেছেন ‘রবীন্দ্র গবেষণা ট্রাস্ট’। ঠিক তেমনি ভাষাসংগ্রামী সম্মাননা হিসেবে একটি সংগঠন থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে চেষ্টা করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক বিপন্ন ভাষাসংগ্রামীর জীবনমান উন্নয়নে পাশে দাঁড়াতে।

সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়, পথচলায় আগাগোড়া সামষ্টিক অগ্রসরমাণতায় বিশ্বাসী তিনি।

পাকিস্তান আমলে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে বাঙালিদের নিগৃহীত’ এই ভাবনা থেকে যেমন ছয় বন্ধু মিলে ‘ওরিয়ন ল্যাবরেটরিজ’ নামের ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন তেমনি ষাটের দশকজুড়ে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন সাহিত্যপত্রিকা নাগরিক; যে পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে হাসান আজিজুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণের উষাকালের বহু স্মরণীয় লেখা।

২০০৬ সালে হারিয়েছেন স্ত্রী সৈয়দা রুহুল হাসিনকে। তবু কি নিঃসঙ্গ তিনি? না, নিত্যসঙ্গী হয়ে তো আছে সাহিত্যচর্চা আর মানবমুক্তির নানা প্রয়াসে বিরামহীন যুক্ততা।

আজ তাঁর জীবনের ৯১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এখনো লিখে চলেছেন পরিকল্পিত রবীন্দ্রজীবন-এর ৫ম খণ্ড, সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অসমাপ্ত রচনার নতুন ভাষ্য এবং বিদ্যাসাগরের দুই শ বছর সামনে রেখে একটি ভিন্নধর্মী গবেষণাকর্ম।

ঢাকা সিটি করপোরেশন ইস্কাটনে তাঁর বাসার সামনের সড়কের নামকরণ করেছে ‘ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক সড়ক’। আহমদ রফিক এটা নিয়ে বিব্রত; শতাব্দীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তাঁর প্রত্যাশা—বাংলাদেশ হাঁটুক সাম্য, সম্প্রীতি ও সুষম আগামীর সড়কে।