অর্থনীতিবিদ সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি আলোচনা সভায় যেভাবে মবের ঘটনা ঘটছে, তা খুবই আতঙ্কজনক। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সরকার মবের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। যারা মব সন্ত্রাস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে যারা সেখানে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন, সেই মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকদেরই গ্রেপ্তার করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির এই সদস্য বলেন, একটা ফ্যাসিবাদকে সরিয়ে আরেকটা ফ্যাসিবাদে ফিরে যাওয়ার জন্য চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে তরুণেরা প্রাণ দেননি। যেসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং যেসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন হয়েছিল, তা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অধ্যাপক যতীন সরকারের প্রয়াণে নাগরিক শোকসভায় আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী এই শোকসভার আয়োজন করে। সভাপতিত্ব করেন উদীচীর সহসভাপতি ইকরামুল কবির।
শুরুতেই মঞ্চের পাশে রাখা যতীন সরকারে প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তব অর্পণ করে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর উদীচীর শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন ‘আগুনের পরশমণি’ গানটি। উদীচীর সাবেক সভাপতি, শিক্ষাবিদ, মার্ক্সবাদী চিন্তক ও প্রাবন্ধিক যতীন সরকার ১৩ আগস্ট ৮৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ছিল একপক্ষের যুক্তিখণ্ডনের জন্য অন্য পক্ষের যুক্তি উত্তাপন, লেখার জবাবে লেখা, মতের প্রতিবাদে পালটা মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এক বছর পরে এখন দেখা যাচ্ছে, এই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আগের ফ্যাসিবাদী আমলের মতোই ভিন্নমতকে বলপ্রয়োগে দমন করা হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেয়ালে দেয়ালে বৈষম্যবিরোধী গ্রাফিতি আঁকা হয়েছিল। কিন্তু আবার জাতি, গোষ্ঠী, শ্রেণি, নারীর প্রতি বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। যতীন সরকার সারা জীবন এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের চিন্তা ও মনোজগতের পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছেন। তাঁর কাজ ও চিন্তাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সামনে আরও লড়াই করে যেতে হবে। সেই লড়াইয়ে যতীন সরকারের চিন্তা আমাদের শক্তি জোগাবে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যতীন সরকারের একটি বড় গুণ ছিল, তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যেতে পারতেন। মার্ক্সীয় রাজনীতির তত্ত্ব খুব সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারতেন। যে স্বল্পসংখ্যক রাজনীতিক তত্ত্ব ও প্রয়োগকে একসঙ্গে মিলিয়ে চর্চা করতে পেরেছিলেন, যতীন সরকার ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি সৃজনশীলতা ও সমাজের নতুন নতুন উপকরণ মিলিয়ে তত্ত্ব প্রয়োগের নতুন পদ্ধতি অনুসন্ধানের পক্ষপাতি ছিলেন।
দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, যতীন সরকার ইতিহাসকে খণ্ডিত না করে সামগ্রিকভাবে দেখতেন। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে গুণীজনের কদর ও প্রশংসা করতেন। আবু সাঈদ খান বলেন, ‘মবতন্ত্রের কারণে এখন স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করা ভয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। এই “প্রেশার গ্রুপ” থেকে আমরা পরিত্রাণ পেতে চাই। এটা নিশ্চিত হওয়া এখন সময়ের দাবি।’
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘যতীন সরকার ছিলেন অনুসরণ করার মতো মানুষ। দায়িত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলার মতো একজন মানুষ। তিনি দেখিয়েছেন মানুষ ও দেশকে ভালোবাসতে কোনো মতাদর্শের প্রয়োজন হয় না। সারা জীবন ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এলাকায় থেকেছেন। ঢাকামুখী হননি। বরং প্রান্ত থেকে কেন্দ্রকে জয় করেছেন। তিনিই সম্ভবত এ ধরনের শেষ ব্যক্তি। তিনি যে কাজ করে গেছেন, সেই মূলধনকে নিয়ে আমরা যদি সামনে এগিয়ে যাই, তবেই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানান হবে।’
উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জমশেদ আনোয়ারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ছিল গান ও আবৃত্তি। যতীন সরকারের মেয়ে সুদীপ্তা সরকার পারিবারিক কাজের জন্য অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তিনি একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। সেটি পাঠ করা হয়। যতীন সরকারের জীবনী পাঠ করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সদস্য একরাম হোসেন। একক সংগীত পরিবেশন করেন আবদুল ওয়াদুদ ও মায়েশা সুলতানা। আবৃত্তি করেন দীপক সুমন ও মৌমিতা জান্নাত।
আলোচনায় আরও অংশ নেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও শিশু-কিশোর সংগঠক লেনিন চৌধুরী, উদীচীর সহসভাপতি আমিনুর রহমান ও হাবিবুর রসুল, সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ নূর, সমাজ অনুশীলন কেন্দ্রের নেতা রঘু অভিজিৎ রায়, অধিকারকর্মী ও লেখক বাকী বিল্লাহ প্রমুখ।