দাবি পূরণের আশ্বাসে গভীর রাতে যমুনা থেকে সরলেন আহতরা

বিক্ষুব্ধদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। রোববার দিবাগত রাতেছবি: সাজিদ হোসেন

দাবি পূরণের আশ্বাসে গভীর রাতে হাসপাতালে ফিরে গেলেন জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা। রোববার দিবাগত রাত পৌনে দুইটার দিকে তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে থেকে চলে যান। এর আগে সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিসহ ৭ দফা দাবিতে রাত সোয়া ১২টার দিকে যমুনার সামনে এসে বিক্ষোভ দেখান তাঁরা।

রাত পৌনে দুইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ যমুনার সামনে সাংবাদিকদের জানান, আহতদের দাবিগুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে তিনি আলোচনা করবেন। তাঁদের দাবি অন্য কোনো সরকার নয়, একমাত্র অন্তর্বর্তী সরকারই পূরণ করবে।

রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নিয়েছেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। তাঁদের একজন বসে আছেন হুইলচেয়ারে। রোববার দিবাগত রাতে
ছবি: সাজিদ হোসেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের এমন আশ্বাসের পর আন্দোলনরত আহতরা যমুনার সামনের সড়ক ছেড়ে যান।

এর আগে রোববার দিনভর আগারগাঁও ও শ্যামলীতে মিরপুর রোডে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। ওই রাস্তা ছেড়ে সন্ধ্যার পর তাঁরা মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে যাত্রা করেন। রাত পৌনে আটটায় শাহবাগে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পৌঁছালে পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়। এরপর সেখানেই তাঁরা অবস্থান নেন।

আন্দোলনকারীদের একজন আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাত পৌনে ১২টার দিকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের কাছে গিয়ে অবস্থান নেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই অবস্থান করবেন বলে জানান।

রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা। রোববার দিবাগত রাতে
ছবি: সাজিদ হোসেন

রাত সোয়া ১২টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে যান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি আন্দোলনকারীদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। তবে আন্দোলনকারীদের চিৎকার ও হট্টগোলের কারণে তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। এ সময় হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে থাকা নেতারা তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করেন।

এ বিক্ষোভের শুরু গত শনিবার সন্ধ্যায়। বিদেশে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, পুনর্বাসন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সম্মাননাসহ বিভিন্ন দাবিতে ওই দিন সন্ধ্যায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা বিক্ষোভ শুরু করেন। রাতে এক পর্যায়ে তাঁরা আগারগাঁও সড়ক আটকে দেন। গতকাল সকালে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান-নিটোর) চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরা। সাভারের সিআরপিসহ বিভিন্ন সময় হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া আহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ এ বিক্ষোভে অংশ নেন।

আন্দোলনকারীদের অন্যান্য দাবির মধ্যে রয়েছে জুলাই আন্দোলনের যোদ্ধাদের সরকারি গৃহায়ণ বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, তাঁদের পরিচয়পত্র দেওয়া ও রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা; যাঁর যাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করা; নারী যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা; বিনা মূল্যে বিমান, রেল ও বাসে চলাচলের ব্যবস্থা, যানবাহন ক্রয়ে শুল্ক-কর পরিহার করা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক রাষ্ট্রীয় অতিথিশালাগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া।

আরও পড়ুন
প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে যাত্রা করেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের থামিয়ে দেয়। গতকাল রাত সাড়ে আটটায়
ছবি: আশরাফুল আলম

এর আগে গত ১৩ নভেম্বর আহত ব্যক্তিদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সবার সঙ্গে দেখা করেননি—এ অভিযোগে তাঁর গাড়ি আটকে বিক্ষোভ করেন আহত ব্যক্তিরা। পরে তাঁরা হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন গভীর রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের চারজন উপদেষ্টা ও একজন বিশেষ সহকারী সেখানে গিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা ভোরে বিক্ষোভকারীদের হাসপাতালে ফিরিয়ে নেন। এর পরদিন ১৪ নভেম্বর সচিবালয়ে আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে সরকারের বৈঠক হয়। বৈঠকে সরকার জুলাই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার পাশাপাশি পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কথা জানিয়েছিল।

আবার বিক্ষোভ, মানুষের ভোগান্তি

এর আড়াই মাস পর আহত ব্যক্তিদের একটা অংশ আবার বিক্ষোভে নামে। রোববার সকালে তাঁরা আগারগাঁওয়ের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সামনে থেকে জাতীয় রাজস্ব ভবন পর্যন্ত সড়কের দুই পাশ আটকে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। বেলা সোয়া ১১টার দিকে তাঁরা সেখান থেকে শ্যামলী শিশুমেলার সামনে এসে মিরপুর রোড অবরোধ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন।

বেলা আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সোহেলী নামের এক নারী তাঁদের দাবি মেনে নিতে বিকেল চারটা পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন।

এ সময় শিশুমেলার সামনে পদচারী-সেতুর কাছে কামরুল নামের এক আন্দোলনকারী গলায় রশি পেঁচিয়ে অবস্থান নেন। তিনি ঘোষণা দেন, বিকেল চারটার মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দিলে গলায় ফাঁস দেবেন তিনি।

উন্নত চিকিৎসাসহ অন্যান্য দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে যাত্রা করেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের থামিয়ে দেয়। গতকাল রাত সাড়ে আটটায়
ছবি: আশরাফুল আলম

আন্দোলনকারীরা ওই সড়ক ছেড়ে দেন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে। এরপর তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। কেউ হেঁটে, কেউ রিকশায় রওনা হন। এ সময় আমিনুল ইসলাম (ইমন) নামের এক আন্দোলনকারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি ১৯ জুলাই মালিবাগে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানান। আমিনুল ইসলাম বলেন, তাঁরা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করার পর সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আলোচনা করতে আসেননি। তাই তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দাবি আদায় করতে রওনা হয়েছেন।

এর আগে দিনভর আন্দোলনকারীরা যে সড়ক (মিরপুর রোড) অবরোধ করে রাখেন, সেটি পার হয়ে আশপাশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে যেতে হয়। দূরদূরান্ত থেকে এসব হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা গণপরিবহন না পেয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

চোখ দেখাতে যাত্রাবাড়ী থেকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আসেন ষাটোর্ধ্ব নূরজাহান বেগম। সঙ্গে ছিলেন মেয়ে ও ছেলের বউ। সকাল সাতটায় বাসা থেকে রওনা হয়ে তাঁরা হাসপাতালে আসেন। দুপুর ১২টায় চিকিৎসক দেখানো শেষে যাত্রাবাড়ীতে ফিরে যাওয়ার জন্য কোনো বাস পাচ্ছিলেন না। হেঁটেই পথ এগোতে থাকেন।

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে আসা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে আধা ঘণ্টার বেশি সময় হেঁটে শিশু হাসপাতালে আসেন কাকলি বেগম। সড়ক বন্ধ থাকায় বাস থেকে নেমে তাঁদের হাঁটতে হয়েছে।

আরিচা থেকে আসা লিটন মিয়া হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে যাবেন। বাস থেকে নেমে রিকশায় করে শিশুমেলা মোড় পর্যন্ত এসে বাকি পথ স্ত্রী ও ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। এ ছাড়া অফিসগামী ও ঢাকার বাইরে যাওয়ার যাত্রীরাও পড়েন ভোগান্তিতে।

আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ

সড়কে অবস্থান নেওয়া বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন কবির হোসেন। আন্দোলনের সময় তাঁর চোখে গুলি লেগেছিল। কবিরের বাড়ি মিরপুর ১১ নম্বরে। তিনি বলছিলেন, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। তাঁকে এখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁর সমস্যা যায়নি। হাসপাতালে এলে একটা ড্রপ ও ব্যথার ওষুধ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর সুচিকিৎসা দরকার।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়া ধীরগতির, তা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। এখন হাসপাতালে যাঁরা আছেন, তাঁদের চিকিৎসা ঠিকমতো করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ। তাঁদের দাবি, এ জন্য সুচিকিৎসা দিতে হবে, প্রয়োজনে বিদেশে পাঠাতে হবে।

বিক্ষোভকারীদের একজন মো. দুলাল। হাতে আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন মাস আগে সরকারের পক্ষ থেকে সুচিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই। এখন পর্যন্ত কোনো ভালো চিকিৎসা পাননি তিনি।