বাংলাদেশের ফিড ইন্ডাস্ট্রির সামগ্রিক অবস্থা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের জন্য ফিডের চাহিদা গত কয়েক বছরে কীভাবে বদলেছে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ জসিম উদ্দিন: আমাদের ফিডশিল্প বর্তমানে একটি পরিপক্ব ও শক্তিশালী খাতে রূপ নিয়েছে। প্রতিবছর ৬৫ থেকে ৭০ লাখ মেট্রিক টন ফিড ব্যবহৃত হচ্ছে, যার মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। গত এক দশকে পোলট্রি, ডেইরি ও অ্যাকুয়া ফার্মিং খাতের দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে ফিডের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এখন এই খাত দেশের প্রোটিন নিরাপত্তা ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভে পরিণত হয়েছে।
ফিড উৎপাদনে বর্তমানে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী? বিশেষ করে কাঁচামালের দাম, আমদানিনির্ভরতা বা রেগুলেটরি ইস্যু নিয়ে কিছু বলুন।
শেখ জসিম উদ্দিন: বর্তমানে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানিনির্ভরতা। সয়াবিন মিল, প্রিমিক্স ও এনজাইম–জাতীয় উপাদান এখনো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, ডলার–সংকট ও এলসি জটিলতা এই খাতে সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায়।
আকিজ ফিডের যাত্রা শুরুর পেছনের মূল ভাবনা কী ছিল? আপনারা কীভাবে পণ্যের পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করছেন?
শেখ জসিম উদ্দিন: আমরা শুরু থেকেই বিশ্বাস করি, ফিড নয়, আমরা দিচ্ছি পুষ্টির প্রতিশ্রুতি। দেশের অনেক খামারি গুণগত ফিডের অভাবে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পান না। সেই অভাব পূরণ করতেই আকিজ ফিডের যাত্রা। আমরা প্রতিটি ফিড ফর্মুলা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ, মাঠপর্যায়ের তথ্য ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিই।
নিরাপদ, পুষ্টিকর ও বৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি ফিড—এই মান বজায় রাখতে আকিজ ফিডের অভ্যন্তরীণ কৌশল ও প্রক্রিয়াগুলো কেমন?
শেখ জসিম উদ্দিন: আকিজ ফিডে কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স (কিউএ) ও কোয়ালিটি কন্ট্রোল (কিউসি) কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে প্যাকেজিং পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই আধুনিক পরীক্ষাগার, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট টিম এবং আন্তর্জাতিক মানের যন্ত্রপাতি (যেমন জার্মান প্রযুক্তি) ব্যবহার করা হয়। আমাদের লক্ষ্য একটাই, খামারিদের হাতে নিরাপদ ও কার্যকর ফিড তুলে দেওয়া।
বাংলাদেশের খামারিদের মধ্যে সাধারণত কোন সমস্যাগুলো বেশি লক্ষ করেন? সেগুলোর সমাধান দেওয়া এবং ফিড নিয়ে খামারিদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আপনারা কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
শেখ জসিম উদ্দিন: খামারিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সঠিক পুষ্টিজ্ঞান ও খরচ-লাভ বিশ্লেষণের অভাব। এ জন্য আমরা নিয়মিত সেমিনার, মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণ এবং টেকনিক্যাল সার্ভিস টিমের মাধ্যমে খামারিদের পাশে থাকি। আমরা চাই, খামারি যেন শুধু ফিড নয়, বরং একটা পূর্ণাঙ্গ সমাধান পান—যা পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনের সমন্বয়ে তৈরি।
সাশ্রয়ী মূল্যে উচ্চমানের ফিড—এই লক্ষ্য পূরণে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত কীভাবে ভারসাম্য রাখা হয়?
শেখ জসিম উদ্দিন: আমরা কাজ করি ‘কস্ট ইফেক্টিভ নিউট্রিশন’ ধারণার ভিত্তিতে, যেখানে মান বজায় রেখে এমন ফরমুলেশন তৈরি করা হয়, যাতে ‘ফিড কনভারশন রেশিও’ ভালো থাকে, খরচ কমে এবং খামারির লাভ নিশ্চিত হয়। ফিডের পুষ্টিমান ধরে রাখতে কাঁচামালের মান ও ধারাবাহিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য আমরা আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘মাদার ভেসেল’ ব্যবহার করে দেশি ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করি। এর ফলে আমরা নিয়মিতভাবে একই মানের ও সঠিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন কাঁচামাল সরবরাহে সক্ষম হই।
এ ছাড়া লোকাল ও গ্লোবাল সাপ্লায়ারের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ এবং শক্তিশালী কোয়ালিটি চেকিং প্রটোকলের মাধ্যমে আমরা মূল্য ও মানের একটি ভারসাম্য বজায় রাখি। এর ফলে আমরা খামারিদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি উচ্চমানের অথচ সাশ্রয়ী ফিড, যা তাঁদের উৎপাদনে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
দেশের অন্যতম ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে খামারিদের আয় বৃদ্ধিতে আকিজ ফিড কীভাবে ভূমিকা রাখছে?
শেখ জসিম উদ্দিন: উৎপাদনশীলতা ও প্রাণিসম্পদের সুস্থতা নিশ্চিত করেই খামারির আয় বাড়ানোই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা যে ফিড সরবরাহ করি, তাতে থাকে সুষম ও বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারিত পুষ্টি উপাদান, যেমন প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল, ভিটামিন ও এনজাইম; যা পশুর প্রয়োজনীয় বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। এই সঠিক পুষ্টি প্রাণীর দেহে দ্রুত ও স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, ফলে খামারি কম খরচে বেশি উৎপাদন পান এবং তাঁর লাভ নিশ্চিত হয়।
পাশাপাশি আমাদের দক্ষ টেকনিক্যাল সার্ভিস টিম মাঠপর্যায়ে খামারিদের পাশে থেকে কাজ করে তাঁদের ফিড ব্যবস্থাপনা, রোগপ্রতিরোধ, পরিবেশ ও হাউজিং–সংক্রান্ত গাইডলাইন এবং খামার পরিচালনার সঠিক কৌশল সম্পর্কে পরামর্শ দেয়। আমরা বিশ্বাস করি, সঠিক পুষ্টি ও সঠিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয়েই একটি খামার লাভজনক, স্বাস্থ্যবান ও টেকসই হতে পারে, আর সেখানেই আকিজ ফিড সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই কৃষি গড়তে পরিবেশবান্ধব বা ইকোফ্রেন্ডলি ইনোভেশন বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাই।
শেখ জসিম উদ্দিন: আমরা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে বিশ্বাসী। কম পানি ব্যবহার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং নিশ্চিত করছি। ভবিষ্যতে আইওটিভিত্তিক স্মার্ট ফার্মিং চালু করব, যেখানে ফিড, পরিবেশ ও প্রাণীর স্বাস্থ্য একসঙ্গে প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এতে খরচ ও পরিবেশ—দুই দিকই সুরক্ষিত থাকবে।
বাংলাদেশের ফিড ইন্ডাস্ট্রিকে আরও টেকসই ও বিশ্বমানের করতে হলে কী ধরনের নীতিগত বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন সবচেয়ে জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
শেখ জসিম উদ্দিন: এ খাতকে আরও টেকসই করতে হলে দরকার কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাটছাড়, ভেটেরিনারি ও কৃষিপ্রযুক্তিতে গবেষণা ও প্রণোদনা এবং খামারিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া এই শিল্প কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোবে না।
বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাই। পাশাপাশি আপনাদের গ্রাহকদের উদ্দেশে কী বার্তা দিতে চান?
শেখ জসিম উদ্দিন: যাঁরা প্রতিনিয়ত প্রাণিসম্পদকে সুস্থ রাখা ও মানোন্নয়নের পেছনে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, ওয়ার্ল্ড ভেটেরিনারি ডে তাঁদের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি দিন। পশুচিকিৎসকদের অবদান ছাড়া নিরাপদ খাদ্য বা লাভজনক প্রাণিসম্পদ কল্পনা করা যায় না।
আর গ্রাহকদের বলতে চাই, আকিজ ফিড শুধু ফিড নয়, একটি দায়িত্বের নাম। পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি—এই তিন স্তম্ভ নিয়ে আমরা আপনাদের পাশে আছি। আসুন, আমরা একসঙ্গে একটি স্বাস্থ্যবান ও টেকসই কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।