সাক্ষাৎকার: এম এ ফয়েজ

চার ধরনের সাপ বেশি কামড়ায়

কেবল বর্ষাকালে নয়, বৃষ্টি বেশি হলে সাপের উপদ্রব বাড়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর চার লাখ তিন হাজারের বেশি মানুষ সাপের দংশনের শিকার হন। এর মধ্যে মারা যান সাড়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ। রোগীর প্রাণ বাঁচাতে অ্যান্টিভেনমসহ বিভিন্ন ওষুধের দরকার হয়। প্রান্তিক পর্যায়ের রোগীদের সচেতনতার অভাব, ভ্রান্ত ধারণা, হাসপাতালগুলোয় সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসাজনিত ঘাটতি, পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনমের ঘাটতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম এ ফয়েজ। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাহমিদা আক্তার।

টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এম এ ফয়েজ
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

দেশে কত প্রজাতির বিষধর সাপ আছে?

এম এ ফয়েজ: দেশে কত প্রজাতির সাপ আছে, তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো জরিপ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বিভিন্ন জায়গার হাসপাতাল এবং চিকিৎসকেরা কোন ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে ধারণা করা যায় ১০-১২ প্রজাতির মতো বিষধর সাপ আছে। এর মধ্যে ফণাতোলা সাপের মধ্যে আছে পদ্ম গোখরা ও খইয়া গোখরো। এরা একই রকম ফণা তুললেও পদ্ম গোখরোর ফণাতে একটি বলয় থাকে। এই প্রজাতির সাপ সারা দেশেই আছে। খইয়া গোখরোর বলয় একটি নয়, এর বলয় চশমার মতো। এটি বাংলাদেশের যমুনা নদীর পশ্চিম দিকে বেশি পাওয়া যায়। আরেকটি বিষধর সাপ হলো রাজগোখরো। চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে এটি বেশি দেখা যায়। বিষধর শাখিনীর কমপক্ষে পাঁচটি প্রজাতি আছে (কালাচ)। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবুজ বোড়া সাপ বেশি দেখা যায়। এটিরও কয়েকটি প্রজাতি আছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরেক মারাত্মক বিষধর সাপ চন্দ্রবোড়ার বিস্তার দেখা গেছে। বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের বক্তব্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১৭-১৮টির মতো জেলায় এই সাপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিষধর সাপ কালকেউটে সব জায়গাতেই দেখা যায়। আর বড় কালকেউটে পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে।

প্রশ্ন :

কোন প্রজাতির সাপে কাটার ঘটনা বেশি?

এম এ ফয়েজ: যেহেতু আলাদা করে কোনো জরিপ হয় না, সে ক্ষেত্রে কোন প্রজাতির সাপ বেশি দংশন করে, তা একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের উপসর্গ দেখে ধারণা করা হয় চার ধরনের সাপ বেশি দংশন করে থাকে। এর মধ্যে আছে পদ্ম গোখরো, বিভিন্ন ধরনের ক্রেইট বা শাখিনী, সবুজ বোড়া ও চন্দ্রবোড়া।

প্রশ্ন :

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের দংশনের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ভুক্তভোগী গ্রামীণ অঞ্চলের। আমাদের প্রান্তিক পর্যায়ে এসব রোগীর চিকিৎসায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ বা অ্যান্টিভেনম আছে কি?

এম এ ফয়েজ: সাপের দংশনের চিকিৎসার জন্য যে ধরনের ওষুধগুলো লাগে, তার একটি হলো অ্যান্টিভেনম। সাপের কামড়ের রোগীর শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে, শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিডনিতে জটিলতা হতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু শারীরিক জটিলতা হতে পারে, যেগুলোর জন্য রোগীকে আলাদা করে চিকিৎসা বা ওষুধ দিতে হয়। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ে সাপে কামড়ানো মানুষদের বেশির ভাগই হাসপাতালে আসতে দেরি করে ফেলেন, যার কারণে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। প্রান্তিক পর্যায়ের সাপে কামড়ানো রোগীরা যখন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন না, তখন হাসপাতালে সংরক্ষণ করে রাখা অ্যান্টিভেনমগুলো নষ্ট হয়।

আরও পড়ুন
যুক্তরাজ্যে ব্যবহৃত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

কোন প্রজাতির সাপ কামড়েছে, সেটা কি অ্যান্টিভেনম দেওয়ার আগে বুঝতে হয়?

এম এ ফয়েজ: খুব একটা বিষধর নয়, এমন সাপে কামড়ানো রোগীও অনেক ভর্তি হন। সাপে কাটলেই অ্যান্টিভেনম দেওয়া যাবে না। অ্যান্টিভেনমেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তবে বিষধর সাপ কামড়েছে কি না, তা নিশ্চিত হতে বাংলাদেশে একটিও পরীক্ষা নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই নেই। শুধু রক্ত জমাট বাঁধছে কি না, সে পরীক্ষাটি করা যায়। এ ক্ষেত্রে উপসর্গের ভিত্তিতে চিকিৎসককে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি তাতে সাপে কামড়ানো রোগীদের জন্য হাসপাতালে আলাদা কোনো ইউনিট নেই। সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েই তাঁদের চিকিৎসা নিতে হয়। এসব রোগীকে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সাপে কামড়ানোর জায়গাটি ফুলে গেল কি না, রোগীর চোখে দেখতে সমস্যা হচ্ছে কি না, ওপরের পাতা পড়ে গেছে কি না, পেটে ব্যথা হচ্ছে কি না, হাত–পা অসাড় হয়ে আসছে কি না, এমন লক্ষণ দেখে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, এটি বিষধর সাপের কামড় কি না।

প্রশ্ন :

বিভিন্ন অঞ্চলে সাপে কামড়ানো রোগীদের চিকিৎসা দিতে পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষিত নার্স ও চিকিৎসক আছে কি?

এম এ ফয়েজ: আমাদের দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কারিকুলামে সাপের কামড়ের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় না, এটি সত্যি। তবে কিছুটা হলেও পড়ানো হয়। ততটুকু জ্ঞান ছাড়া তো কেউ চিকিৎসক হতে পারবেন না। সুতরাং সাপে কামড়ানো রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারেন না, এমনটা বলার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে হবে। এতে কারও কোনো জায়গায় জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করে নেওয়া যায়। যদি সাধারণ সাপে কাটা রোগীরই চিকিৎসা না দেওয়া যায়, তাহলে ক্যানসারসহ অন্য জটিল রোগীদের চিকিৎসা কীভাবে দেওয়া যাবে।

প্রশ্ন :

বলা হয় বাড়িতে কার্বলিক অ্যাসিড রাখলে নাকি সাপ আসে না। কথাটি কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত?

এম এ ফয়েজ: আমাদের দেশে আসলে সাপের কামড় নিয়ে নানা গালগপ্পো আছে। যেমন নানা উপাখ্যান কিংবা চলচ্চিত্রে সাপে দংশনের পর বিষ নামানো নিয়ে যেসব দৃশ্য দেখানো হয়, সেগুলোও অনেকে বিশ্বাস করে বসেন। তাঁরা মনে করেন, অ্যান্টিভেনম বা ওষুধের দরকার হয় না। কার্বলিক অ্যাসিডের বিষয়টিও একেবারে ভ্রান্ত একটি ধারণা। এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং বাড়িতে কার্বলিক অ্যাসিড রাখলে আরও ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কার্বলিক অ্যাসিড যে পাত্রে রাখা হবে কোনোভাবে সে পাত্রের ঢাকনা খুলে গেলে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে, তা কারও গায়ে পড়ে সমস্যা হতে পারে, ছোটরা কেউ খেয়েও ফেলতে পারে।

আরও পড়ুন
ঘেরের পানিতে মেছো সাপের মহড়া। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার শৌলমারী থেকে তোলা।
ফাইল ছবি প্রথম আলো

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকতে মাঝে মাঝেই সামুদ্রিক বিষধর সাপ দেখতে পাওয়ার খবর পাচ্ছি আমরা। তো এসব বিষধর সাপের জন্য কোনো অ্যান্টিভেনম কি বাংলাদেশে আছে?

এম এ ফয়েজ: ডাঙার সাপের জন্য অ্যান্টিভেনম আলাদা। আমাদের দেশে ডাঙার সাপই বেশি। সামুদ্রিক সাপের জন্য অ্যান্টিভেনম ভারতেও তৈরি হয় না। অস্ট্রেলিয়ায় এ ধরনের অ্যান্টিভেনম আছে। আমাদের দেশে সামুদ্রিক সাপের ব্যাপারে খুব একটা জানাশোনাও নেই। তবে আমি মনে করি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় হলেও এ ধরনের কিছু পরিমাণ অ্যান্টিভেনম সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন :

আমাদের দেশে অ্যান্টিভেনম আসে ভারত থেকে। দেশেই বড় আকারে অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা হচ্ছে বলে আমরা জানি। এর অগ্রগতি কতটুকু? এ থেকে কী উপকার আসতে পারে?

এম এ ফয়েজ: যে অ্যান্টিভেনম আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলোর অব্যাহত কার্যকারিতা পরীক্ষা করা এবং ভবিষ্যতে এখানেই অ্যান্টিভেনম তৈরি করা যাবে কি না, তা নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। আমাদের এখানে এ ধরনের গবেষণা সময়সাপেক্ষ বিষয়। দুই-তিন বছরের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন নয়। এটি একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। প্রথমে দেশে যে ধরনের সাপ আছে, সে ধরনের সাপের বিষ সংগ্রহ করতে হয়। তারপর তা প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করতে হয়। এরপর ওই প্রাণীর শরীরে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। বিষের বিভিন্ন ধরনসহ আধুনিক প্রযুক্তির পরীক্ষা প্রোটিওমিকস, ভেনোমিকসসহ অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণার জন্যও সাপের বিষ সংগ্রহ করতে হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে চলমান গবেষণার প্রথম পর্যায়ের কাজগুলো তাঁরা করতে পেরেছেন। সাপ সংগ্রহ করা, সংরক্ষণ করা, এদের চরিত্র দেখা—এ কাজগুলো তাঁরা করছেন। ধাপে ধাপে কাজগুলো করতে হবে। এটি খুব ভালো একটি উদ্যোগ। এটি সাসটেইন করা দরকার।

প্রশ্ন :

গ্রাম পর্যায়ে সাপে কামড়ানো নিয়ে রোগীদের কীভাবে সচেতন করা যায়?

এম এ ফয়েজ: গ্রাম পর্যায়ে রোগীরা হাসপাতালে না এসে প্রথমে ওঝার কাছে যান। সেখানেই অনেক দেরি হয়ে যায়। তাঁদের মধ্যে যে সচেতনতার অভাব, আমি মনে করি সেটা আমাদেরই ব্যর্থতা। তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কারিকুলামে এ–সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বিষয়বস্তু যুক্ত করতে হবে। গণমাধ্যম, মসজিদের ইমাম এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

হাসপাতালগুলোয় অ্যান্টিভেনমের সরবরাহ কীভাবে ঠিক রাখা যায়?

এম এ ফয়েজ: রোগী এলে তখন স্বাভাবিকভাবেই সরবরাহ ঠিক থাকবে। সে জন্য এ দুটি বিষয়ের সমন্বয় করতে হবে। রোগীরা যেন ওঝার কাছে না গিয়ে হাসপাতালে আসেন, তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি সাপ্লাই চেইনও ঠিক রাখতে হবে। আমি মনে করি, উপজেলা পর্যায়ে অন্তত এক দুজনকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো অ্যান্টিভেনম সংরক্ষণ করতে হবে। তা শেষ হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসতে হবে। জেলা পর্যায়ে ডিপো রাখতে হবে। পাশাপাশি সাপের কামড়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য জটিলতাগুলোর চিকিৎসা–সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে।