৪০০ একরে জলাবদ্ধতা শতাধিক বাড়িতে পানি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে একটি খালে বাঁধ দেওয়ায় প্রায় ৪০০ বিঘা জমি দুই বছর ধরে জলাবদ্ধ হয়ে আছে। পানি উঠেছে শতাধিক বাড়িঘরেও। জলাবদ্ধতা থেকে পরিত্রাণ পেতে এক বছর আগে উপজেলা প্রশাসনে অভিযোগ দেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানতে চাইলে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরিফুল ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। বেশি কিছু জানি না। তবে তেজখালী এলাকায় খালে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করার কথা শুনেছি। আমি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বাঞ্ছারামপুরের তেজখালী ইউনিয়নের তেজখালী, বিষ্ণুরামপুর, বাহেরচর (বাড়াইলচর) গ্রামের মাঝে একটি সরকারি বিল রয়েছে; নাম কাজির বিল। এ বিল ঘিরে তিন গ্রামের প্রায় ৪০০ বিঘা কৃষিজমি আছে। তিন গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। বৃষ্টির সময় গ্রামগুলোর পানি কাজির বিল থেকে তেজখালীর মাকুয়ার খাল হয়ে তিতাস নদে চলে যায়। কিন্তু তেজখালী গ্রামের কয়েকজন ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মাকুয়ার খালের ওপরে সেতুর দুই পাশ ভরাট করে বাড়ি তৈরি করেন। সেখানে বালু ফেলায় মাকুয়া খালটি বন্ধ হয়ে গ্রাম তিনটিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং ওই ফসলি জমিগুলোতে চাষাবাদ বন্ধে হয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষ্ণুরামপুর গ্রামের এক কৃষক বলেন, ‘আমরা এলাকাবাসী মিলে গত বছর ওই বালু সরিয়ে মাকুয়া খালে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে ইউএনওর কাছে অভিযোগ দিয়েছিলাম। তিনি দুইবার এলাকায় এসেছেনও। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আজও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রশাসনের গাফিলতিতে এসব জমিতে গেল দুই বছরে প্রায় দুই কোটি টাকার ফসল উৎপাদন করা যায়নি। আমাদের দাবি, অবিলম্বে মাকুয়া খালটি দখলমুক্ত করা হোক।’

এলাকাবাসীর অভিযোগটি তদন্ত করেন তেজখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কমল রঞ্জন দাস। তিনি ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর ইউএনওর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তাতে বলা হয়েছে, তেজখালী গ্রামের মৃত ইদন মিয়ার চার ছেলে ইউনুছ মিয়া, আয়েব আলী, সাহেব আলী ও আতস আলী এবং ছোট্ট মিয়ার চার ছেলে মিন্টু মিয়া, ধন মিয়া, মাখন মিয়া ও কনু মিয়া ওই খাল ভরাট করেছেন। খাল ভরাট নিয়ে কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে এবং যেকোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতে পারে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়।

তবে ভরাটকারীদের একজন ইউনুছ মিয়া বলেন, ‘এইখানে কোনো খাল ছিল না। আমাদের বাপ-দাদার জায়গার ওপর বালু ভইরা বাড়ি বানাইছি। সরকারি খাল অইল অন্যদিক দিয়া। মাইনসে দখল কইরা ভইরা ফালাইছে।’

এদিকে খালটিকে দখলমুক্ত করে এলাকাবাসীকে বিপদ থেকে রক্ষার দাবিতে ৯ নভেম্বর খালের বাহেরচর (বাড়াইচর) গ্রামের কৃষক সিরাজ মিয়া (৭০) আদালতে ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেনতিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালে বালু ফেইলা বাঁধ দেওয়ায় তিন গ্রামের ৪০০ বিঘা ফসলি জমি পানির নিচে চলে গেছে। সামান্য বৃষ্টি অইলে বাড়ি তলাইয়া যায়। আমরা এই এলাকার মানুষ খুব কষ্টে আছি।’

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, তেজখালী গ্রামের মাঝামাঝি পাকা সড়কের ওপর একটি সেতু। তার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে মাকুয়ার খালে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। ভরাট করা জায়গার ওপরে দুটি ঘর। এতে করে সেতুটি অকেজো হয়ে পড়েছে। সেতুর দক্ষিণ পাশে খালটি শুকিয়ে গেছে। উত্তর পাশ পানিতে টইটম্বুর।

পাশের বিষ্ণুরামপুর গ্রামের দক্ষিণে ও বাহেরচর গ্রামের পশ্চিমে বিস্তীর্ণ এলাকার জমি চার-পাঁচ ফুট পানির নিচে। পুরো এলাকার ফসলি জমিতে কাজির বিলের কচুরিপানা ভরে গেছে। আবার এই শুকনো মৌসুমেও শতাধিক বাড়ির উঠানে পানি। সেখানে এখনো এক থেকে দেড় ফুট পানি জমে আছে।

বাহেরচর গ্রামের কৃষক মানিক মিয়া বলেন, ‘ওইখানে আমার চার কানি (চার বিঘা) জমি আছে। জমিতে আমন ধান করছিলাম। খালে বাঁধ দিয়া পানি যাওয়া বন্ধ কইরা দেওনে ধান আর ঘরে তুলতে পারি নাই। আমার জমিতে আইজ মরিচ থাকার কথা। কিন্তু পানি না যাওয়ায় আমরা পথে বওনের মতো অইছে।’

গত ৪ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘খালে বাঁধ, ৪০০ বিঘা জমিতে জলাবদ্ধতা’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।