রাজশাহীতে আ.লীগ সদর্পে, বিএনপি ধীরে

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খারুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খারুজ্জামান লিটন ও বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল

এ এইচ এম খারুজ্জামান লিটন মেয়র থাকাকালে রাজশাহী সিটির বিস্তর উন্নয়ন হয়েছে। অন্যদিকে, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল দায়িত্ব নেওয়ার পর উন্নয়ন তেমন হয়নি। তাই নগরবাসীর অনেকে মনে করেন, মেয়র ক্ষমতাসীন দলের হলে এলাকার উন্নয়ন হয়। সুতরাং এবার লিটনেরই জেতা উচিত।

কিন্তু নগরীর সাহেববাজার এলাকায় রিকশাচালক আমির হোসেন বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি। বাস্তবতা হলো প্রচারে বিএনপিকে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। পোস্টার লাগাতে দিচ্ছে না। মামলা-হামলা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। প্রচারে নামতে দিলে এবং লিগ্যাল ভোট দিলে কিন্তু লিটন সাহেবের খবর আছে।’

নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া একাধিক সিটি নির্বাচনের ফল বলে দিচ্ছে, ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী লিটনই জিতবেন। ভোটাররা মনে করেন, এই সমীকরণের কারণে মেয়র পদে লিটন ছাড়া অন্য প্রার্থীদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো নয়। লিটনের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারে নগরী এক অর্থে ছেয়ে গেছে। সরগরম মিছিলে-মাইকিংয়ে।

অন্যদিকে, নগরীর সড়কগুলোয় বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের পোস্টার-ফেস্টুন বা প্রচার খুব একটা দৃশ্যমান নয়। ভোটারদের একটি অংশ মনে করে, ভোট সুষ্ঠু হলে বিএনপির প্রার্থীই জিতবেন। সে জন্য ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন নেই। তাই তাঁরা ঢাকঢোল না পিটিয়ে নীরবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা ভোটগ্রহণের দু-চার দিন আগে ব্যাপক প্রচারে নামবেন।

সার্বিক এই পরিস্থিতিকে দুই বাক্যে বলা যায়, আওয়ামী সদর্পে এগিয়ে চলেছে। বিএনপি চলছে ধীরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির জেলা কমিটির সভাপতি ও মোসাদ্দেক হোসেনের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ রাতারাতি প্রধান সড়কগুলো দখল করে পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানার লাগিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের পোস্টার লাগাতে হলে তাদের পোস্টার অপসারণ করতে হবে। সেটা তো সম্ভব নয়। গলিতে পোস্টার লাগাতে গেলে তারা আমাদের কর্মীদের মারধর করে ছেড়ে দিয়েছে। তো আমরা কী করব?’

লিটনের শক্তি
নির্বাচনে লিটনের বড় পুঁজি হলো তিনি আগের মেয়াদে মেয়র থাকাকালে রাজশাহী সিটিতে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বুলবুলের মেয়াদে তা হয়নি। যে কারণে ভোটারদের অনেকের মতে, মেয়র ক্ষমতাসীন দলের না হলে এলাকার উন্নয়ন হয় না। তাই এ নির্বাচনে লিটনেকেই ভোট দেবেন।

অপর একটি অংশ মনে করে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আর সুষ্ঠু না হওয়ার অর্থ হলো ভোটে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী জিতবেন। ‘ভোট নষ্ট না করা’র প্রচলিত এই ধারণার কারণেই তাঁরা লিটনকে ভোট দেবেন বলে জানান।

ভোটাররা আরও মনে করেন, বুলবুল দুই দফায় জেল খেটেছেন ছয় মাস। অফিস করেছেন ২৬ মাস। বাকি সময় তিনি পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এ সময় তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে সিটি করপোরেশনের কাজে সময় দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বর্তমানে এই বিষয় নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘রাজশাহীতে ভোটারের সংখ্যায় আওয়ামী লীগ আমাদের চেয়ে পিছিয়ে। যে কারণে তারা প্রচারে গাজীপুর আর খুলনা সিটির ভোটের উদাহরণ টেনে ভোটারদের বলছে, ভোট দাও আর নাই দাও, মেয়র আমাদের।’

ভোটারদের বড় একটি অংশের অভিযোগ, বুলবুল সিটি করপোরেশনের মেয়রের পদের চেয়ে বিএনপির রাজনীতি এবং দলীয় পদ-পদবি বেশি উপভোগ করেন। যে কারণে তিনি সিটি করপোরেশনের কাজে মনোযোগী ছিলেন না। ভোটারদের মত হলো বুলবুল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারতেন, যেমনটা অতীতে করেছিলেন মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। ভোটারদের এই মনোভাবও লিটনের ভোটবাক্সকে এগিয়ে রাখবে।

গত ঈদের আগে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বকেয়া ছিল। এটা নিয়ে আন্দোলন হয়। পরে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বেতন দেওয়া হয়। এ ছাড়া বর্তমানে ব্যাংকের কাছে করপোরেশনের বিশাল অঙ্কের ঋণ আছে, যা লিটনের মেয়াদে ছিল না। আওয়ামী লীগের প্রচারে এটিও কাজ লাগানো হচ্ছে।

এসব বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, বুলবুল সাহেব মেয়র হওয়ার পর একবারের জন্য সচিবালয়েও যাননি। এটা একজন দায়িত্বশীল মেয়রের কাজ হতে পারে না। মানুষের জন্য কিছু করতে হলে সরকারের কাছে চাইতে হবে। তিনি সেটা করেননি। সে জন্যই মানুষ এবার তাঁকে ভোট দেবে না। তা ছাড়া রাজশাহীর মানুষ আরও জানে যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতে আবারও সরকার গঠন করবে। সুতরাং এলাকার উন্নয়ন করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে।

বুলবুল যেখানে এগিয়ে
ভোটাররা ভোটের রাজনীতির ইতিহাসকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর কারণ, রাজশাহীতে ১৯৭৩ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয় পাননি। যে কারণে কেউ কেউ এই অঞ্চলকে বিএনপির ভোটের ঘাঁটি হিসেবে অভিহিত করেন।

এ ছাড়া ভোটারদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব আছে বলেও ধারণা পাওয়া যায়। যে কারণে বিএনপির নেতৃত্বের একটি অংশ মনে করে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে মেয়র পদে বুলবুল আবারও জয়ী হবেন।

আশার পাশাপাশি বিএনপির নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে যথেষ্ট আশঙ্কাও কাজ করছে। তাঁদের দাবি, বর্তমানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভোটের মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। ভোটগ্রহণের এক-দুই দিন আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হতে পারে। বিষয়টি তাদের ভোটারদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

১৭ জুলাই নগরীর সাগরপাড়া বটতলার মোড়ে রাজশাহী জেলা ছাত্রদল গণসংযোগ করার সময় ককটেল হামলার ঘটনা ঘটে। গত শনিবার একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর অভিযোগ উঠেছে, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাটি বিএনপিই ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় দলটির জেলা সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টুকে পুলিশ আটক করেছে। ভোটারদের অনেকের মতে, বিষয়টির বুলবুলের ভোটের বাক্সে ভোটের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে।

ভোটাররা কী বলেন
ভোটাররা কথা বলেন, কিন্তু নাম প্রকাশে সহজে আগ্রহী হন না। নগরীর কোর্ট এলাকার এক দোকানি বলেন, লিটন সাহেবের মেয়াদে রাজশাহী সিটিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছিল। বুলবুল সাহেবের সময়ে কিছুই হয়নি। তাই এবার ভোটাররা লিটন সাহেবের কথা বেশি বলেছেন।

একই এলাকার একজন নারী ভোটার বলেন, বুলবুল জিতলে আবার জেলে যাবেন। না জিতলে জেলে যাবে না। সুতরাং না জেতাই ভালো। মানুষও তা-ই বলে। তবে নিরপেক্ষ ভোট হলে হিসাব কিন্তু উল্টে যেতে পারে।

কোর্ট এলাকার আম ব্যবসায়ী মারফ বলেন, নির্বাচনে ঘাপলা হবে। তাই লিটন সাহেবই জিতবেন।

গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা নাজমুল হোসনে বলেন, ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের। লিটন সাহেবও আওয়ামী লীগের। ক্ষমতা যেখানে, উন্নয়নও সেখানে। এটাই এবারের ভোটের হিসাব।

বর্ণালী মোড়ে কথা হয় রাজশাহী কলেজের ছাত্রী মিনা খাতুন ও তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে। দুজনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রাজনীতি নয়, দরকার উন্নয়ন। তাই লিটনকে ভোট দিতে হবে।

একই এলাকার আহসান হাবিব বলেন, ‘বুলবুল নগরীতে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়িয়েছেন অস্বাভাবিক হারে। এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ আছে। আমিও অসন্তুষ্ট।’