'রাস্তায় ফেলে গেলেও ছেলেটা বাঁচতে পারত'

সাইদুর রহমান (পায়েল)
সাইদুর রহমান (পায়েল)

হাসিমুখেই কোহিনূর আক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ছোট ছেলে সাইদুর রহমান (পায়েল)। গাড়িতে উঠেই ফোনে মাকে বলেছিলেন, ‘টেনশন কোরো না। ভোরে ঢাকা পৌঁছেই ফোন দেব।’ সেই ফোনটি আর আসেনি। গত সোমবার মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে ছেলের লাশ উদ্ধারের কথা শোনেন মা। এরপর যা জানতে পারেন তাতে হৃদয় আরও ভেঙে আসে। দুর্ঘটনায় আহত ছেলেটাকে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে পানিতে ফেলে দিয়েছেন পাষাণ পরিবহনকর্মীরা। মায়ের আক্ষেপ, ‘অন্তত ওই অবস্থায় রাস্তায় রেখে গেলেও হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।’

গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের হালিশহরে সাইদুরদের বাসায় কোহিনূর আক্তার এভাবে ছেলের জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন। গত শনিবার রাতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র সাইদুর রহমান। ঢাকায় আসার আগে মহাসড়কে বাস থেকে নামার পরে নিখোঁজ হন সাইদুর।

লাশ উদ্ধারের পর তদন্তে সাইদুর নিহত হওয়ার ঘটনার সঙ্গে বাসকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় বাসের চালক জামাল হোসেন, চালকের সহকারী (হেলপার) ফয়সাল ও সুপারভাইজার মো. জনিকে। চালক জামাল ও হেলপার ফয়সাল আপন ভাই। এর মধ্যেই সুপারভাইজার জনি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, বাসে ওঠার সময় সাইদুর পড়ে গিয়ে আহত হলে তাঁরা তিনজন মিলে তাঁকে একটি সেতু থেকে নিচে ফেলে দেন।

এ নিয়ে গতকাল মুন্সিগঞ্জে সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল আলম বলেন, হানিফ পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব-৯৬৮৭ নম্বরের বাসে দুই বন্ধু মহিউদ্দিন, হাকিমুর রহমানসহ ঢাকায় আসছিলেন সাইদুর। বাসের একেবারে সামনে (চালকের পেছনের) আসনে (৩ ও ৪) পাশাপাশি বসেছিলেন সাইদুর ও মহিউদ্দিন। রোববার ভোর চারটার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া উপজেলার ভবের চর এলাকায় সেতুর কাছাকাছি যানজটের মধ্যে ‘বাথরুম’ করতে সাইদুর বাস থেকে নামেন। তিনি বাসে ওঠার আগেই যানজট ছাড়ায় বাস চলতে শুরু করে। সাইদুর দৌড়ে বাসের কাছে যান। বাস ততক্ষণে ভাটের চর সেতুর ওপর উঠেছে। সাইদুরকে বাসে ওঠানোর জন্য দরজাও খোলেন বাসকর্মীরা। তবে ওঠার সময় স্বয়ংক্রিয় দরজার সঙ্গে জোরে ধাক্কা খান সাইদুর। তাঁর মাথা, নাক, মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েন তিনি। বাসকর্মীরা ধারণা করেন, তিনি মারা গেছেন। বিষয়টি নিয়ে ঝামেলার আশঙ্কায় তাঁরা ওই সেতুর ওপর থেকেই ফুলদী নদীতে সাইদুরকে ফেলে দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন।

এসপি বলেন, ময়নাতদন্তে সাইদুরের পেটে প্রচুর পানি পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা যায়, পানিতে ফেলে দেওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ তিনি জীবিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে নিহত সাইদুরের বন্ধু ও সহযাত্রী মহিউদ্দিন বলেন, তখন তাঁরা বাসে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম ভাঙার পর বন্ধুকে না পেয়ে হেলপারকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর আসে, ‘আপনার বন্ধু বাস থেকে নেমে গেছে, পরের বাসে আসবে।’ এ সময় সাইদুরের মোবাইল ফোনটি বাসের আসনেই পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।

ছেলের কথা উঠতেই ছলছল মা কোহিনুর বেগমের চোখ। পাশে হতবিহ্বল বাবা গোলাম মাওলা ও ভাই গোলাম মোস্তফা (বাঁয়ে)। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
ছেলের কথা উঠতেই ছলছল মা কোহিনুর বেগমের চোখ। পাশে হতবিহ্বল বাবা গোলাম মাওলা ও ভাই গোলাম মোস্তফা (বাঁয়ে)। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসায়। ছবি: সৌরভ দাশ

মা কীভাবে মেনে নেবেন?
চট্টগ্রামের হালিশহরে সাইদুরদের বাসা। সেখানে মা কোহিনূর আক্তার একাই থাকেন। বাবা গোলাম মাওলা আর বড় ভাই গোলাম মোস্তফা কাতারপ্রবাসী। বিয়ের পর বড় বোনেরও আলাদা সংসার। তাই ছোট ছেলে সাইদুর রহমানই ছিলেন মায়ের আবেগের সবটুকু। সেই ছেলেটাই এমনভাবে জীবন হারালেন, যা কিছুতেই মানতে পারছেন না মা।

৮ জুলাই বড় ভাই কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন। এই সুসংবাদ শুনেই সাইদুর এসেছিলেন। নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভাতিজির নামও দেন-মাহানুর রহমান।

গতকাল সন্ধ্যায় সাইদুরদের বাসায় কথা হয় তাঁর বাবা গোলাম মাওলা, বড় ভাই গোলাম মোস্তফা এবং মা কোহিনূর আক্তারের সঙ্গে।

ঢাকা থেকে বাসায় ফিরলে যে খাটে ঘুমাতেন সাইদুর, সেই শূন্য খাটের দিকে তাকিয়ে বারবার শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ছেন মা কোহিনূর।

সাইদুরের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সোমবার দেশে এসেছেন সাইদুরের বাবা ও বড় ভাই। গোলাম মাওলার আক্ষেপ, শেষবারের মতো ছেলেকে দেখতে পারেননি। কারণ, লাশ বিকৃত হয়ে যাওয়ায় কফিন খোলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি এখন আমার ছেলেকে হত্যাকারীদের দেখতে চাই। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটি করতে চাই, কেন তারা ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেলল?’