মসলা ও বনৌষধি পিপুল

পিপুলগাছ। বগুড়া সদরের মধুমাঝিড়া গোলাবাড়ি গ্রামে।  ছবি: লেখক
পিপুলগাছ। বগুড়া সদরের মধুমাঝিড়া গোলাবাড়ি গ্রামে। ছবি: লেখক

মাস কয়েক আগে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার যোগীপাড়া গ্রামে মাটিতে অনেক লতিয়ে যাওয়া পিপুলগাছ দেখেছিলাম। এক বয়স্ক কৃষক তা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন বাজারে মরিচ পাওয়া যেত না, তখন আমরা পিপুলের ফল দিয়ে মরিচের কাজ সারতাম। তার মানে পিপুল ফল খাওয়া যায়, স্বাদ ঝাল।’

পরবর্তী সময়ে দেশের আরও অনেক জায়গায় পিপুলের দেখা পাই। সর্বশেষ দেখা মেলে বগুড়া সদর উপজেলার লাহিড়িপাড়া ইউনিয়নের মধুমাঝিড়া গোলাবাড়ি গ্রামে মো. রফিকুল ইসলামের বাড়িতে। বনে–জঙ্গলে আপনা–আপনি জন্মায় পিপুল। তবে রফিকুল গাছ লাগিয়েছেন। তিনি প্রতিবছর পিপুল ফল তুলে একমি ল্যাবরেটরিজের লোকদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি কেজি ১ হাজার ৪০০ টাকা। ৮ থেকে ১০ বছর ধরে পিপুল চাষ করছেন তিনি।

গাছটি এ দেশে দুষ্প্রাপ্য নয়। কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের ধারণা কম। ঔষধার্থে পিপুলগাছের মূল ও অপক্ব ফল ব্যবহার করা হয়। পিপুল ফল স্বগোত্রীয় গোলমরিচের চেয়ে বেশি ঝাল। এ জন্য ভেষজের চেয়ে মসলা ও খাদ্য সংরক্ষণের কাজে বেশি ব্যবহার করা হয়। পিপুলের বীজ পপি বীজের মতো সূক্ষ্ম কণাবিশিষ্ট।

আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর চিরঞ্জীব বনৌষধি বইয়ে বেদে পিপুলের নাম কন বা কণা বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, পিপুল খুব সূক্ষ্ম হয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে বলে এর এমন নাম। দ্রব্যটি শরীরে প্রবেশ করে রসধাতু পান করে নেয় আবার সূক্ষ্ম হয়ে বেরিয়ে যায়। তার এই পান বা শোষণ করার ধর্ম থেকে নাম রাখা হয়েছে পিপ্পল, এ থেকে পিপ্পলি, পিপলি বা পিপুল। তামিল শব্দ পিপ্পলি থেকে পিপুল নামের উদ্ভব।

বৈদিক যুগে পিপুল ছিল সর্বাধিক ব্যবহৃত ভেষজ গাছ। এর ইংরেজি নাম লং পেপার বা ইন্ডিয়ান লং পেপার। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম piper longum। পরিবার পিপারেসি।

পিপুল লতানো স্বভাবের গাছ। অবলম্বন পেলে বেয়ে ওপরে ওঠে, না পেলে মাটিতেই পড়ে থাকে। লতার আগা কোমল, পাতার রং গাঢ় সবুজ, নিচের পিঠ হালকা সবুজ। পত্রকÿথেকে পুষ্পমঞ্জরি বের হয় ও ফল ধরে। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথক গাছে আলাদাভাবে ফোটে। ফুল মঞ্জরিতে ফোটে। বর্ষাকালে ফুল হয়, শরৎকালে ফল। ফল ডিম্বাকার অনেকটা মরিচের মতো, অমসৃণ ও কুঁচকানো। ফল হালকা সবুজ, কমলা ও হলুদ রঙের হয়। পাকলে ফলের রং লাল হয়ে যায়। শিকড় ধূসর বাদামি ও লম্বালম্বিভাবে কুঁচকানো।

ভারত ও নেপালে মসলা হিসেবে পিপুলের ব্যবহার দেখা যায়। বিশেষ করে আচার ও চাটনি তৈরিতে পিপুল চূর্ণ মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় কোনো কোনো খাবার রান্নায় পিপুল ব্যবহার করা হয়। ভারতে মুদি দোকানে পিপুল–চূর্ণ পাওয়া যায়। পাকিস্তানে নেহারি রাঁধতে পিপুল–চূর্ণ এক আবশ্যক মসলা।

পিপুলের জন্মভূমি প্রাচীন ভারতের মগধ দেশে বলে দাবি করেছেন শিবকালী ভট্টাচার্য। মগধ দেশ ছিল বর্তমান বিহার প্রদেশের দ‌ক্ষিণাংশ। কোশল বা উত্তর প্রদেশও ছিল মগধের অঙ্গভূমি। এ জন্য পিপুলের আর একটি নাম মাগধী। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও আসাম, নেপাল, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, তিমুরে পিপুল বেশি জন্মে।