'ট্রাকটি থামিয়ে দিলেই ভাইবোন বেঁচে যেত'

কেরানীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশু আফসার আহমেদ ও আফিফা আক্তার।  সংগৃহীত
কেরানীগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিশু আফসার আহমেদ ও আফিফা আক্তার। সংগৃহীত
>

• দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের জয়দেবপুরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে
• ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে নিহত হয় দুই ভাইবোন
• আফিফা পঞ্চম শ্রেণিতে, আফসার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত
• তিন সন্তানের মধ্যে দুজনকে হারিয়ে দিশেহারা বাবা–মা

বেলা ১১টায় স্কুল যখন ছুটি হয়েছিল, আফিফা আক্তার আফরিন তার অপেক্ষমাণ বাবাকে এসে জানিয়েছিল, ‘সুই–সুতা’ প্রতিযোগিতার মহড়ায় সে প্রথম হয়েছে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা শামসুল আলম বলেছিলেন, ‘তোমার ভাই এলেই আমরা বাড়ি যাব।’ ছেলে আফসার আহমেদ আসার পর দুই সন্তানকে মোটরসাইকেলে করে রওনা দেন শামসুল। আর বড়জোর ৫০০ মিটার, তারপরই অপেক্ষমাণ মায়ের সঙ্গে দেখা হতো তাদের। ঠিক তখনই ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে না–ফেরার দেশে চলে গেছে দুই ভাইবোন।

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের জয়দেবপুর এলাকায় গতকাল সোমবার মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বাবা। কিন্তু তাঁর বেঁচে থাকাটাও যে অন্তঃসারশূন্য। আহত শামসুল আলমের কাছে যখন সাংবাদিকেরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন, তখন দুই সন্তানের মৃত্যুর বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বলছিলেন, ‘আর না, আমার জানটা ছিইড়া যায়।’ কেরানীগঞ্জের কসমোপলিটন ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী ছিল দুই ভাইবোন। বড় বোন আফিফা পঞ্চম শ্রেণিতে আর ছোট ভাই আফসার পড়ত তৃতীয় শ্রেণিতে। শামসুল আলম প্রতিদিন তাদের স্কুলে আনা–নেওয়া করতেন।

দুর্ঘটনার পর চালক মো. নবীন রডভর্তি ট্রাক (ঢাকা মেট্রো ট ১৬-১৯৪৭) নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁর বাড়ি বরিশালের রশিদপুরে। বেলা সোয়া একটার দিকে আবদুল্লাহপুর-ধলেশ্বরী সেতুর কাছে ট্রাকটি পরিত্যক্ত অবস্থায় জব্দ করে পুলিশ। এদিকে দুই সহপাঠীর মৃত্যুর সংবাদে দুপুর ১২টায় স্কুলের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। পলাতক গাড়িচালককে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে তারা ঢাকা-মাওয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। একটি ট্রাক ও তিনটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয় তখন। ৪০ মিনিট পর পুলিশ দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেয়।

দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাকের মালিক মো. ইব্রাহিম প্রথম আলোকে বলেন, চার দিন আগে বরিশাল থেকে গাছ নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন চালক নবীন। রড নিয়ে বরিশালে ফেরার সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি চালকের মুঠোফোন বন্ধ পাচ্ছেন বলে জানান। ইব্রাহিমের দাবি, নবীনের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে।

দুর্ঘটনাটি ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের যেখানে ঘটেছে তার অল্প আগেই একটি মোড় রয়েছে। দুই পাশে রাস্তার কাজ চলায় এখানে গাড়িগুলোকে এক লেন থেকে আরেক লেনে যেতে হয়। ইলিয়াস আহমেদ নামে দুর্ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, লেন পরিবর্তনের পর ট্রাকটি মোটরসাইকেলকে পাশ কাটানোর সময়ই দুর্ঘটনাটি ঘটে। ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালক সামনে ছিটকে পড়েন। আর শিশু দুটি ট্রাকের নিচে চলে যায়। ট্রাকটি তাদের কিছু দূর ছেঁচড়ে নেয়। এরপর ওপর দিয়ে চলে যায়। তাঁর মতে, তৎক্ষণাৎ ট্রাকটি থামিয়ে দিলে শিশু দুটি বেঁচে যেত।

শিশু দুটির বাবা শামসুল আলম বলেন, ছিটকে পড়ার পরপরই কয়েক মিনিটের জন্য তিনি জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন মোটরসাইকেলটি পড়ে আছে। বাচ্চাদের খুঁজতে গিয়ে দেখেন কিছু দূরে তারা পড়ে আছে।

তিন সন্তানের মধ্যে দুজনকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মা পুতুল বেগম। মুঠোফোনে দুই সন্তানের ছবি দেখে তিনি হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। ছবিতে চুমু দিচ্ছিলেন বারবার। আফিফা আর আফসারকে নাম ধরে ডাকছিলেন বারবার। আহাজারি করে বলছিলেন ‘হায় আল্লাহ্ তুমি এ কী করলা। তুমি আমারে নিয়া গেলা না কেন?’ মিটফোর্ড হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর সন্ধ্যায় লাশ দুটি বাড়িতে নিয়ে গেলে আরও হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পুতুল বেগম, বারবার সন্তানদের লাশের কাছে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন। স্বজনেরা তাঁকে জড়িয়ে ধরে আটকে রাখেন। ‘তোমরা স্কুলে যাবা না কালকা। আমারে লয়া যাওয়া, আমিও যামু তুমগো লগে’। কথাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পুতুলের আহাজারি তখন পাড়া–পড়শিদের চোখও ভিজিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন: