বনবিড়াল আর মেছোবাঘের ছানার গলাগলি

বিছানায় একসঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত বনবিড়াল ও মেছোবাঘের ছানা। গত ৩০ জানুয়ারি পাখি ও বন্য প্রাণী সেবাকেন্দ্র সোলের কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
বিছানায় একসঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত বনবিড়াল ও মেছোবাঘের ছানা। গত ৩০ জানুয়ারি পাখি ও বন্য প্রাণী সেবাকেন্দ্র সোলের কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো
>

• গলাগলি করে থাকে বনবিড়ালের দুটি ও মেছোবাঘের একটি ছানা
• ডাকলেই তানিয়া খানের কোলে উঠে বসে
• আদর কম করেন না তানিয়াও

বনে হয়তো একের সঙ্গে অন্যের দেখাই হতো না। সবাই যার যার পথে ছুটে চলে। কখনো যদি দেখাও হতো, সম্পর্কটা বিবাদেরই হওয়ার কথা। প্রজাতি এক হলেও তাদের জাত আলাদা। কিন্তু ঘরের ভেতর একই কক্ষে জাতপাত ভুলে দিব্যি তারা দুষ্টুমি করে সময় কাটিয়েছে। খুনসুটিতে একটা আরেকটার ওপর চড়াও হয়েছে।

আলাদা জাতের বন্য প্রাণী একত্রে থাকার এই পরিবেশ তৈরি করেছিলেন মৌলভীবাজারে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পাখি ও বন্য প্রাণী সেবাকেন্দ্র সোলের (সেভ আওয়ার আন প্রোটেক্টেড লাইফ) পরিচালক তানিয়া খান। দুটি বনবিড়াল ও একটি মেছো বাঘের ছানা তাঁর থাকার কক্ষেই কাটিয়েছে প্রায় দুই মাস। ৬ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টার থেকে ছানাগুলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া এলাকার বনে চলে গেছে। কিন্তু বনবিড়ালের ছানাগুলো এখনো তানিয়া খানের মায়া ভোলেনি। ভোলেননি তানিয়া খানও। এখনো বনের কাছে ছুটে যান তিনি। নাম ধরে ডাক দিলেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে বনবিড়ালের ছানা দুটো। খাবার খেয়ে দুষ্টুমি করে আবার বনে চলে যাচ্ছে।

সম্প্রতি একাধিকবার মৌলভীবাজার শহরতলির কালেঙ্গা এলাকায় সোলের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, দুটি বনবিড়ালের ছানা ও একটি মেছো বাঘের ছানা অনেকটা গলাগলি করে সময় পার করছে। একটা আরেকটার সঙ্গে দুষ্টুমি করছে। গলা ধরে, গলা খামচে একে অপরকে আক্রমণ করছে। কিন্তু হিংস্রতা নেই। এ ক্ষেত্রে মেছো বাঘের ছানা কিছুটা সতর্ক ছিল। খুব ধীর লয়ে পা ফেলে সে চলাফেরা করে। তবে তানিয়া খানের কাছে এদের কোনো জড়তা নেই। একেবারে মাতৃশিশুর মতো কোলে-কাঁখে লাফিয়ে উঠছে। তানিয়া খানও আদরে আঁকড়ে ধরছেন।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ ডিসেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলার ভাসানিগাঁওয়ের একটি সবজিখেত থেকে বনবিড়ালের চারটি ছানা উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। বনবিড়ালের বাচ্চাগুলো ছোট হওয়ায় সেবার জন্য সোলের পরিচালক তানিয়া খানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে দুটি বাচ্চা মারা যায়। অপর দিকে গত ২ জানুয়ারি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সরকার বাজারের একটি কনফেকশনারি থেকে একটি মেছো বাঘের ছানা উদ্ধার করে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। মেছো বাঘের ছানার বয়স কম হওয়ায় বন বিভাগ সোলের কাছে এটিকেও হস্তান্তর করে। সারা সময় আতঙ্কে থেকেছে এটি। এটির ভয় কাটতে সময় লেগেছে। শুরুতে এদের তরল খাবার খাওয়ানো হয়েছে। আস্তে আস্তে শক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এরা। বনবিড়ালের ছানা দুটির একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছানা তিনটিকে শুরুতে স্যালাইন ও মাংসের স্যুপ খাওয়ানো হয়েছে। ধীরে ধীরে হাড়-মাংস নিজেরাই চিবিয়ে খাওয়া শিখেছে। এদের তাজা মোরগের মাংস ও তেলাপিয়া মাছ খাওয়ানো হয়েছে। প্রথম দিকে দিনে ছয়বার খাওয়ানো হতো। পরে চারবার। শেষের দিকে তিনবার।

বন বিড়ালের দুটি ছানাকে খাবার দিচ্ছেন তানিয়া খান। গত ১০ ফেব্রুয়ারি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
বন বিড়ালের দুটি ছানাকে খাবার দিচ্ছেন তানিয়া খান। গত ১০ ফেব্রুয়ারি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

৬ ফেব্রুয়ারি বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সোলের কার্যালয় থেকে ছানা তিনটি নিয়ে যায়। পরে এগুলোকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বন্য প্রাণী রেসকিউ সেন্টারে রাখা হয়।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের মৌলভীবাজার রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জানকিছড়া রেসকিউ সেন্টারে ছানাগুলোকে রাখা হয়েছিল। একসময় তারের বেড়ার ফাঁক গলে তিনটাই বেরিয়ে গেছে।

বন্য প্রাণী সংরক্ষক ও গবেষক তানিয়া খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরা বিড়াল প্রজাতির। কিন্তু জাতে আলাদা। বনে এরা পাশাপাশি যেমন থাকে না, হয়তো এদের দেখাও হয় না। কিন্তু আমার কাছে মিলেমিশে ছিল। একসঙ্গে খেলাধুলা করছে। তবে খাওয়ার সময় ঠিকই কাড়াকাড়ি করেছে।’ তানিয়া খান বলেন, ‘বনে চলে যাওয়ার পর তিন দিন ওদের দেখতে গিয়েছি। খাইয়েছি। নাম ধরে ডাকলেই বন থেকে বনবিড়ালের ছানা দুটি ছুটে আসে। যতক্ষণ সেখানে থাকি, কাছাকাছি থাকে। দুষ্টুমি করে। বেশ বড় হয়েছে। টিকে থাকার মতো অবস্থায় চলে গেছে। মেছো বাঘের ছানাটিকে দেখা যায়নি।’