ইউনিকোডে বাংলা রীতি মানা হয়নি

কম্পিউটারে বাংলা হরফ ব্যবহারের জটিলতার চূড়ান্ত সমাধান পদে পদে আটকে থাকছে। অ্যাস্‌কি–ভিত্তিক পুরোনো ফন্টে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট প্রভৃতি ওয়েবক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা যেত না। ফন্টের সর্বজনীন কারিগরি ব্যবস্থা ‘ইউনিকোড’ আসার পর এ জটিলতা দূর হয়েছিল। তাতে সে সংকট দূর হলেও ইউনিকোডের ফন্ট বিন্যাসে বাংলা নিয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

ড়, ঢ়, য়—এই তিনটি বাংলা বর্ণ ইউনিকোডের সর্বশেষ ১১তম সংস্করণে সরাসরি লেখার ব্যবস্থা নেই। ইউনিকোড তৈরি ও ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম ইউনিকোডে বাংলা ভাষার সাংকেতিক ব্যবস্থা বা কোডসেট রেখেছে ভারতের হিন্দি লিপি দেবনাগরীর অনুকরণে। এ কারণে বর্ণগুলো লিখতে ড, ঢ ও য-এর নিচে নোকতা অর্থাৎ বাড়তি একটা ডট (.) দিতে হবে। এটি ভবিষ্যতে ইন্টারনেটে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করবে বলে ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সর্বশেষ হালনাগাদ ইউনিকোডে আরও কিছু অব্যবস্থা বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। বাংলা লেখার স্বাভাবিক প্রকৃতি অনুযায়ী এ-কার, ই-কার, ঈ-কার বর্ণের আগে না করে পরে টাইপ করতে হচ্ছে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত যতিচিহ্ন দাঁড়ির বদলে এসেছে দেবনাগরী বর্ণমালার মোটা ও দীর্ঘ দাঁড়ি। এতে বাংলা ভাষার দ্বৈত দাঁড়ি রাখা হয়নি। বাংলাদেশি টাকার চিহ্নকে অভিহিত করা হয়েছে ‘বেঙ্গলি রুপি’ হিসেবে। ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষা প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, ইউনিকোডে বাংলা ভাষার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউনিকোডের বাংলা এর নিজস্ব ভাষারীতি অনুসারেই হওয়া উচিত।

ওয়েব ঠিকানা লিখতেও সমস্যা হবে

ইন্টারনেটের ডোমেইন ঠিকানা বরাদ্দকারী মার্কিন সংস্থা ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারস (আইসিএএনএন) ইংরেজি ছাড়াও অন্য ভাষায় ওয়েব ঠিকানা বরাদ্দ করে থাকে। বাংলায় ওয়েব ঠিকানার জন্য ডট বাংলাও করা হয়েছে। ইউনিকোডের বাংলা ছকে সরাসরি এই অক্ষরগুলো না থাকায় বাংলায় ওয়েব ঠিকানা লিখতে সমস্যা হবে।

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ভাষা-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মামুন অর রশীদ জানান, ভারতের উদ্যোগে সে দেশে হিন্দি ভাষার অনুসারে নয়টি আঞ্চলিক ভাষার জন্য ইউনিকোডে নিউ ব্রাহ্মী জেনারেশন প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে হিন্দি ভাষার ব্রাহ্মীলিপি থেকে বাংলা লেখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে নোকতা যোগ করে ড়, ঢ় ও য় লেখার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

মামুন অর রশীদ বলেন, ‘বাংলা লিপির উদ্ভব দেবনাগরী থেকে নয়। বাংলা এভাবে থাকলে ইন্টারনেটে বাংলায় ডোমেইন তৈরি করা যেমন সমস্যা হবে, তেমনি সার্চ ইঞ্জিনে তথ্য খুঁজতেও জটিলতার মধ্যে পড়তে হবে। এর সমাধান করতে হলে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম ও আইসিএএনএন—দুই জায়গাতেই আমাদের কথা বলতে হবে।’

এখন ইউনিকোডে যেভাবে বাংলা রয়েছে, সেটা বাংলা হয়নি বলে মনে করেন ভাষাবিজ্ঞানী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হক। তিনি বলেন, হিন্দিতে বা অন্য ভাষায় নোকতা দরকার হলেও বাংলায় দরকার নেই। ইউনিকোড ইন্টারফেসে প্রচুর জায়গা আছে। বাংলা অক্ষরগুলো সেখানে সরাসরি দিয়ে দিলেই হয়।

ইউনিকোডের বাংলা বাংলাদেশের মতের ভিত্তিতে হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মত দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাবিজ্ঞানীরাও। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘নোকতা দিয়ে ড়, ঢ় ও য় লেখার ব্যবস্থা একেবারেই ঠিক নয়। আমরা যেভাবে লিখি, সেভাবেই পুরো অক্ষর তৈরি হতে হবে। বাংলা ও হিন্দি লিপি আলাদা। দুটি প্রায় সমবয়সী। বাংলা দেবনাগরীজাত নয়।’

ইউনিকোডে বাংলা ভাষার সংযুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পবিত্র সরকার বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের বাংলা আকাদেমি ও ভাষাপ্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশের ভূমিকাকে পুরোপুরি সমর্থন করছি। বাংলা ভাষা ও লিপির জন্য বাংলাদেশের আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে।’

ইউনিকোড ও বাংলাদেশ

ইউনিকোডের শুরু ১৯৮৭ সালে অ্যাপল কম্পিউটারের উদ্যোগে। পরে মাইক্রোসফটসহ বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগে যুক্ত হয়ে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম গঠন করে। অ্যাপলের পরিবেশক হিসেবে ১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডে অ্যাপলের একটি সম্মেলনে অংশ নেন আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী এবং বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ইউনিকোডের বাংলায় সে সময় ড়, ঢ়, য় ও ৎ—এই চারটি বর্ণ ছিল না। মোস্তাফা জব্বার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এগুলো যুক্ত হয়।

ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম গঠনের পর বিভিন্ন দেশ এর সদস্য হয়। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এর সদস্য ছিল না। ফলে ইউনিকোডে বাংলা ভাষার ছক কেমন হবে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে কিছু বলা যায়নি। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে বিসিসি ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হয়।

পরবর্তী সময়ে এসেছে ইন্টারনেটে অন্য ভাষার টপ লেভেল ডোমেইন (যেমন, ডট বাংলা) নামের বিষয়টি। এখানেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন আইসিএএনএনের সদস্য হয়।

ইউনিকোড ও আইসিএএনএনের দাবি

এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বাংলা ভাষা নিয়ে ইউনিকোডের বর্তমান ছক একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দিতে যা-ই থাকুক, বাংলায় তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না থাকায় ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেই ইউনিকোডের বাংলা তৈরি করা হয়েছে।

বিষয়টি সমাধানে সরকার একাধিক কমিটি গঠন করেছে। বিসিসি ও বিটিআরসি আইসিএএনএন ও ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সভাগুলোতে ইউনিকোডের বাংলায় বাংলাদেশের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরছে। কিছু দিন পর জাপানে অনুষ্ঠেয় আইসিএএনএনের সভায় বিটিআরসি বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরবে বলে জানা গেছে।