চমকজাগানিয়া ক্যামেলিয়া

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের নার্সারিতে ফুটেছে ক্যামেলিয়া ফুল। সম্প্রতি তোলা ছবি। আশরাফুল আলম
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের নার্সারিতে ফুটেছে ক্যামেলিয়া ফুল। সম্প্রতি তোলা ছবি। আশরাফুল আলম

‘তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ,/ এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।’/জিগেস করলেম, ‘নামটা কী?’ সে বললে, ‘ক্যামেলিয়া।’/ চমক লাগল—’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতায় এভাবেই ক্যামেলিয়া ও এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর চমকের প্রকাশ করেছেন।

মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের নার্সারিতে বেশ কয়েকটি ক্যামেলিয়ার গাছ রয়েছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে নার্সারি ঘুরে দেখা যায়, গাছভর্তি লাল ও গোলাপি রঙের ফুল। শীত মৌসুমের এ ফুলে বিদায়ের সুর। তবে ছোট–বড় কুঁড়ি জানান দিচ্ছে, আরও কিছুদিন থাকবে। পাপড়ির গড়ন, প্রলুব্ধকারী রং আর মনোলোভা সুবাসের জন্য ক্যামেলিয়ার ভিন্নধর্মী আকর্ষণ রয়েছে। এর কালচে উজ্জ্বল সবুজ মোলায়েম পাতা ফুলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।

উদ্যানের নার্সারিতে লাল ও গোলাপ—দুই রঙের ক্যামেলিয়ার দেখা মিলবে। তবে ওয়ারীর বলধা গার্ডেনে ক্যামেলিয়া হাউসে সাত রঙের ক্যামেলিয়াও আছে। এখানে দুষ্প্রাপ্য এই গাছের সংখ্যা কুড়ির অধিক। শান্ত, নিরুত্তাপ মোহনীয় এই ফুল সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক আবদুশ শাকুর লিখেছেন, ‘অল্প কয়েকটি রঙের অল্প কয়েকটি ফুলের কারবার ক্যামেলিয়ার। তবে দুই–ই সুন্দর—ফুল ও রঙ।’

একক ও যুগল পাপড়িবিশিষ্ট এ ফুলে প্রকৃতিবিদেরা গোলাপের আদল খুঁজে পান, রঙে আভাস। কবি–সাহিত্যিকদের কাছে ক্যামেলিয়া মানে আবেগ, অনুভূতি আর শিহরণের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, ‘ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে এই সন্ধ্যায়/ ভালোবেসে যতো খুশি বলতে পারো এই ফুল আমার।/ ফুল শুধু ছড়াবে সৌরভ লজ্জায় বলবে না কিছু’। কবিতার এই লাইনগুলো গায়ক জেমসের সুরে এখনো তরুণদের মনে দ্যোতনা সৃষ্টি করে।

মায়ের সঙ্গে উদ্যানে বেড়াতে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শিপ্রা বসু। ক্যামেলিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ এই তরুণী। শিপ্রা বলেন, ফুল ও গাছ—দুটিতেই কেমন স্নিগ্ধতা। ফুলগুলো যেন সরল, সুন্দর মুখে মনোহারিণী রূপ নিয়ে ফুটে আছে।

বিদেশি সাহিত্যে ক্যামেলিয়া নিয়ে অনেক লোককথাও প্রচলিত আছে। জাপানের হার না–মানা অদম্য যোদ্ধা, যাঁরা সামুরাই নামে পরিচিত। যুদ্ধে যাওয়ার আগে অশুভ ভেবে তাঁরা লাল ক্যামেলিয়া দর্শন করতেন না, তাই অন্যত্র সরিয়ে রাখা হতো। ধারালো তরবারির আঘাতে শিরশ্ছেদের সঙ্গে ক্যামেলিয়ার ঝরে পড়া দৃশ্যের আবার মিল পেয়েছেন জাপানের সাহিত্যিকেরা।

ক্যামেলিয়ার আদি নিবাস জাপান ও কোরিয়া। এর বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া জাপানিকা। ফিলিপাইনের ধর্ম প্রচারক, প্রকৃতিবিদ জর্জ জোসেফ ক্যামেল উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। তাঁর নাম অনুসারে এই উদ্ভিদের নামকরণ করা হয়। ক্যামেলিয়ার উচ্চতা ১০ মিটারের বেশি হয়। তবে পরদেশি এই গাছের উচ্চতা এ দেশে পাঁচ মিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সারা বিশ্বে দুই হাজারের বেশি আবাদি ও সংকর ক্যামেলিয়া রয়েছে।

বলধা গার্ডেনের মালি দুলাল হোসেন বলেন, বিরল ও দামি এই গাছের মেজাজমর্জিমতো যত্ন নিতে হয়। খুব ছায়া অথবা খুব আলো—কোনোটাই সহ্য হয় না।

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক মোল্ল্যা রেজাউল করিম বলেন, জাপান থেকেই জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ক্যামেলিয়া আসে। দৃষ্টিনন্দন এই ফুলের চারা তৈরির পাশাপাশি একটি ক্যামেলিয়ার বাগান তৈরির পরিকল্পনা আছে, যাতে সাধারণ মানুষ ফুলটির সংস্পর্শে আসতে পারে।

অকল্যাণ হবে ভেবে জাপানি নারীরা খোঁপায় ক্যামেলিয়া গুঁজতে ভয় পান। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় অবশ্য সাঁওতাল মেয়েকে ক্যামেলিয়া কানে গুঁজতে দেখা গেছে; যা সাঁওতাল মেয়ের কালো গালের ওপর আলো করেছিল। কানে গোঁজা না গেলেও এ দুটি উদ্যানে ক্যামেলিয়ার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ আছে।