পলিথিনের তেলে চলল মোটরসাইকেল

ড্রামে পলিথিন পুড়িয়ে তা থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের কাজ চলছে। গত রোববার নওগাঁর মান্দা উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
ড্রামে পলিথিন পুড়িয়ে তা থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের কাজ চলছে। গত রোববার নওগাঁর মান্দা উপজেলার হোসেনপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
>
  • সাত কেজি পলিথিন পুড়িয়ে প্রায় পাঁচ লিটার পেট্রল জাতীয় পদার্থ বের হয়
  • আধা লিটার ডিজেল বের হয়
  • পলিথিন পোড়ানোর কালির ছাপার কাজে ব্যবহার করা যায়

বিশেষ পদ্ধতিতে পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানি তেল এবং ছাপার কাজে ব্যবহার করার জন্য কালি উৎপাদন করছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের এক ব্যক্তি। এ তেল ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে মোটরসাইকেল চালানো হয়েছে। আর ছাপাখানায় এ কালি ব্যবহার করে সুফল পাওয়া গেছে।

ওই ব্যক্তির নাম ইদ্রিস আলী (৬৮)। ভটভটি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এসে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নেমে পড়েন জীবনযুদ্ধে। নিজের জমি নেই। শ্বশুরের দেওয়া সামান্য জমিতে মাটির তৈরি বাড়ি। সংসারে তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা কৃষিসহ অন্যান্য কাজ করেন। স্ত্রী নুরজাহান বিবি গৃহিণী। জীবিকার তাগিদে ইদ্রিস আলী কখনো ভ্যান চালিয়েছেন, আবার কখনো করেছেন কৃষিকাজ। এ ছাড়া ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ও সাইকেল মেরামতের কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে ভটভটি (ইঞ্জিনচালিত গাড়ি) চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

ইদ্রিস আলী বলেন, তিন-চার মাস আগে গ্রামের কয়েকজন যুবক চায়ের দোকানে বসে মুঠোফোনে একটি ভিডিও দেখছিলেন। কৌতূহলবশত তিনিও সেটি দেখেন। বড় একটি কারখানায় পলিথিন ব্যবহার করে জ্বালানি তেল তৈরির দৃশ্য দেখানো হয় ওই ভিডিওতে। এরপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন। প্রায় তিন মাসের চেষ্টার পর তাঁর সেই ভাবনাকে তিনি বাস্তবে রূপ দেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে বাজার থেকে তেলের একটি বড় টিনের ড্রাম, একটি মাঝারি প্লাস্টিকের ড্রাম, ছোট দুটি কনটেইনার, প্রায় ১৫ ফুট স্টিলের সরু পাইপ ও কয়েক হাত প্লাস্টিকের ফিতা কিনে কাজ শুরু করেন। প্রথম প্রথম সামান্য সমস্যা হলেও তা শুধরে নিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি পলিথিন থেকে সফলভাবে জ্বালানি তেল ও ছাপার কালি উৎপাদন করতে সক্ষম হন।

ইদ্রিস আলী বলেন, এর আগে বাড়ির আশপাশে যেখানে-সেখানে জমে থাকা পলিথিন অনেক সময় পোড়াতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন, পোড়া পলিথিন থেকে টপটপ করে পানির মতো কিছু ঝরে পড়ছে। তখন বুঝতে পারেননি, এটা আসলে জ্বালানি তেল। ভিডিও দেখার পর জানতে পারেন, পলিথিন পোড়ালে তরল যে পদার্থ বের হয় সেটা পেট্রল জাতীয় এক ধরনের জ্বালানি।

ইদ্রিস আলী বলেন, প্রথমে পলিথিনগুলো টিনের ড্রামে ভরে প্রায় আধা ঘণ্টা ড্রামের নিচে খড়ি দিয়ে জ্বাল দেওয়া হয়। এরপর ড্রাম থেকে নির্গত গ্যাস স্টিলের পাইপ দিয়ে এসে প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে গিয়ে পড়ে। সেই গ্যাস ওই ড্রামে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে জ্বালানি তেলে রূপান্তরিত হয়। সাত কেজি পলিথিন পুড়িয়ে প্রায় পাঁচ লিটার পেট্রল জাতীয় পদার্থ ও আধা লিটার ডিজেল বের করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বদ্ধ টিনের ড্রামে পলিথিন পোড়ানোর ফলে ড্রামের গায়ে কালির আস্তরণ জমা হয়। সেই কালি ছাপার কাজে ব্যবহার করা যায়।

উপজেলার প্রসাদপুর বাজারে আমজাদ প্রেস অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের মালিক আমজাদ হোসেন বলেন, বাজার থেকে কেনা কালির বিকল্প হিসেবে পলিথিন থেকে তৈরি ওই কালি তিনি ছাপার কাজে ব্যবহার করেছেন। এটা ভালোই।

চৌবাড়িয়া বাজারের মোটর মেকানিক রাসেল ও রিপন বলেন, ইদ্রিস আলীর উৎপাদিত জ্বালানি তেল মোটরসাইকেলে ব্যবহার করে দেখেছেন। এতে মোটরসাইকেল চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

ইদ্রিস আলী বলেন, ‘বড় প্ল্যান্ট স্থাপন করে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পলিথিন পোড়ালে বাণিজ্যিকভাবে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা সম্ভব। টাকার অভাবে তা করতে পারছি না।’

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘পলিথিন থেকে ইদ্রিস আলীর জ্বালানি তেল তৈরির খবর শুনেছি। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাগত জানাই। তবে তা কতটা পরিবেশবান্ধব, তাৎক্ষণিকভাবে বলতে পারছি না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।’

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করা হয়। তবে বাংলাদেশে প্রথম গত বছর জামালপুরে তৌহিদুল ইসলাম নামের এক যুবক পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদন শুরু করেন।