আবহাওয়া কেমন যাবে, জানা যাবে অনেক আগে

>

• পূর্বাভাসব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে
• দেশে ২০০ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে
• গভীর সাগরে পূর্বাভাসব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে
• বিভাগীয় শহরে হচ্ছে রেইন গেজ স্টেশন
• নদ-নদীর পানি হ্রাস-বৃদ্ধির তথ্য মিলবে ২৪ ঘণ্টা

বর্ষা আসার বেশ আগেই গত বছর মার্চ মাস থেকে দেশে বৃষ্টি হয়েছিল। এ সময় প্রায় প্রতিদিন আকাশ কালো করে ঘন মেঘ জমে বয়ে যেত কালবৈশাখী। এর সঙ্গে বজ্রপাতে মারা যায় শতাধিক মানুষ। কিন্তু এক বছর পর ২০১৯ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত দেশের আবহাওয়ার এই চিত্র অনেকটাই বিপরীত।

মাঘ–ফাল্গুনে জেঁকে বসেনি শীত। বৈশাখ মাসেও কালবৈশাখী এবার এখন পর্যন্ত গত বছরের মতো বয়ে যায়নি। বৃষ্টিরও বেশ কম। আবহাওয়া ও জলবায়ুর এমন দ্রুত পরিবর্তনের কারণে পূর্বাভাসব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে ২০০টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, গভীর সাগরে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পূর্বাভাসব্যবস্থাও গড়ে তোলা হবে। এ ছাড়া ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বৃষ্টির পূর্বাভাস, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ জানতে রেইন গেজ স্টেশন স্থাপন করা হবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম তথ্য জানিয়ে প্রাণহানি ও কৃষি উৎপাদনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে এর মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে দেশে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পূর্বাভাসসেবার মান বাড়ানো হবে। তবে আধুনিক পূর্বাভাসব্যবস্থার সুফল আরও দুই বছর পর পাওয়া যাবে।

এ জন্য বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে ‘বাংলাদেশ ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট সার্ভিস সার্ভিসেস রিজওনাল প্রজেক্ট’ নামে ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলারের একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এই প্রকল্পের সঙ্গে আবহাওয়া অধিদপ্তর ছাড়াও যুক্ত রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড।

প্রকল্পের অংশ হিসেবে নির্ভুল পূর্বাভাস পেতে ২০০টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে চুক্তি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৯ এপ্রিল সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলনকক্ষে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।

উপজেলা পর্যায়ে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলে জানান আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান। গত ২৭ এপ্রিল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেসব এলাকায় বেশি, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনে এই বিষয় বিবেচনা করা হবে।

সারা দেশে বর্তমানে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৪৩টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, খুলনা ও রংপুর বিভাগে ছয়টি করে ১৮টি, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগে দুটি করে চারটি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২টি, রাজশাহী বিভাগে পাঁচটি এবং বরিশাল বিভাগে চারটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোকে স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে। এর বাইরে আরও ১৫৭টি উপজেলায় নতুন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু পুরোনো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের উপকূলীয় যেসব অঞ্চলে সামুদ্রিক ঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস বেশি হয়, সেই অঞ্চলগুলোয় এবার তুলনামূলক বেশি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। একইভাবে নদীভাঙনকবলিত অঞ্চলগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি কৃষিকাজনির্ভর এলাকা নতুন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র করা হবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের মহানগরীগুলোয় জলাবদ্ধতা একটি বড় সমস্যা। বর্ষাকালের অতিবৃষ্টি ছাড়াও আগাম বর্ষায় সামান্য বৃষ্টি হলেই এসব শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে দুর্ভোগে পড়েন মহানগরবাসী। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরীতে এই সমস্যা প্রকট। তাই ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও রাজশাহী ও বরিশাল মহানগরীতে একটি করে মোট চারটি রেইন গেজ স্টেশন নির্মাণ করা হবে। রেইন গেজ স্টেশন থেকে এই চারটি মহানগরীর সেবা সংস্থাগুলো বৃষ্টির পূর্বাভাস, বৃষ্টির পরিমাণ সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে পারবে।

উপকার মিলবে কৃষকের: আবহাওয়াবিদদের মতে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফসল উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু আগাম বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরাসহ নানা কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে কৃষিক্ষেত্র উপকৃত হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থকরী ফসল) মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে পূর্বাভাসের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এরপর সেই তথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তারপর সেই তথ্য স্থানীয় কৃষকদের কাছে দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ সময়ের বিষয়। তাই ২০০টি নতুন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হলে স্থানীয়ভাবেই সঠিক পূর্বাভাস পাওয়া যাবে। এর ফলে কৃষি কাজের ব্যবস্থাপনা ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে।

বন্যার আগাম তথ্য পাওয়া যাবে: অত্যাধুনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া গেলে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে বলে জানান বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সারা দেশে সাড়ে তিন শ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। বর্তমানে এসব কেন্দ্র থেকে বন্যার আগাম তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। সনাতন পদ্ধতিতে কেবল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নদ-নদী পর্যবেক্ষণ করা যায়। রাতের বেলায় এ কাজ করা যায় না। এই প্রকল্পের আওতায় আরও ৩০৮টি কেন্দ্র স্বয়ংক্রিয় করা হবে। এর ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ১৫ থেকে ৩০ মিনিট পরপর নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যাবে।

সাগর থেকে মিলবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস: বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৪৩ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকলেও বঙ্গোপসাগর থেকে আবহাওয়া–সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায়ই একাধিক ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হয়ে উপকূলীয় অঞ্চল আঘাত হানে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও থাইল্যান্ড গভীর সাগরে একাধিক পর্যবেক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করেছে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রকল্পে বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার তিনটি স্থানে পর্যবেক্ষণ যন্ত্র ‘ওশান বয়’ স্থাপন করা হবে। এর মাধ্যমে দ্রুত সাগরের আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যাবে।

আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওশান বয় গভীর সাগরে ভাসমান অবস্থায় থাকবে। সাগরের তলদেশে কেবল দিয়ে আটকানো থাকবে। সেখান থেকে সাগর পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করবে ওশান বয়। সেসব তথ্য সেন্সরের মাধ্যমে উপগ্রহে পাঠানো হবে। স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সিস্টেমের থেকে সরাসরি আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে দ্রুত চলে আসবে।

আবদুল মান্নান বলেন, ‘ভারতের বিশাল জলসীমা। তারা প্রায় দেড় শ ওশান বয় স্থাপন করেছে। থাইল্যান্ডও এদিক দিয়ে বেশ এগিয়ে রয়েছে। আমরা বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডের সহায়তায় তিনটি ওশান বয় স্থাপন করতে যাচ্ছি।’

এ প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্য আবহাওয়া পরিস্থিতির তথ্য বিশ্লেষণে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। এ জন্য নরওয়েজিয়ান মেট্রলজিক্যাল ইনস্টিটিউট, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে যে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে, সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া হবে। তাদের বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানান আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রযুক্তি সহায়তা নিতে সাড়ে পাঁচ শ এমবিবিএস ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করবে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

সম্ভাব্য আবহাওয়া পরিস্থিতির তথ্য বিশ্লেষণে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দিয়ে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পূর্বাভাস প্রদানে আবহাওয়া অধিদপ্তর অতীতের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। এ জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শামছুদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক জলবায়র পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন চিহ্নিত করতে উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য এখন নতুন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এসেছে। এই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার। আবার যতটা সম্ভব সঠিক পূর্বাভাস দ্রুত জানানোর প্রয়োজন রয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশ ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট সার্ভিস সার্ভিসেস রিজওনাল প্রজেক্টের কাজ চলছে। এর ফল পেতে আরও দুই বছর সময় লাগবে।