দেড় লাখ একর ফসলের ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি। তলিয়ে যাচ্ছে পাকা ধান। দ্রুত ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকেরা। গতকাল দুপুরে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরে।  ছবি: খলিল রহমান
ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি। তলিয়ে যাচ্ছে পাকা ধান। দ্রুত ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকেরা। গতকাল দুপুরে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওরে। ছবি: খলিল রহমান
>

• ক্ষতির প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে মন্ত্রণালয়
• আশঙ্কা অনুযায়ী বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি
• সবচেয়ে বেশি ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে বরগুনায়
• ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে

ঘূর্ণিঝড় ফণী দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করায় স্বস্তি ফিরলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ফণীর প্রভাবে সারা দেশে ২১ হাজার ৩৩টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুরোপুরি বা আংশিক ক্ষতি হয়েছে দেড় লাখের বেশি একর জমির ফসল।

ফণীর প্রভাবে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ জেলার তিনটি হাওরের তিনটি স্থানে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে অবশিষ্ট ধান কাটা নিয়ে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা। যদিও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তেমন ক্ষতি হবে না। কারণ, ৯৪শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। বাকি ধানও কাটা হচ্ছে। এ ছাড়া ১২টি জেলায় প্রায় ২২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

গতকাল রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. শাহ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আশঙ্কা অনুযায়ী বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বাঁধের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং কৃষকের যেটুকু ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেবে। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করা, খাবার দেওয়াসহ আনুষঙ্গিক সহায়তার কাজ ইতিমধ্যেই শুরু করেছে।

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় ফণী গত শুক্রবার সকালে ভারতের ওডিশায় আঘাত হানে। সেটি দুর্বল হয়ে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে গত শনিবার সকালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার। ওই দিন রাতে সেটি আরও দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ অতিক্রম করে। তবে এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দমকা, ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টিতে মানুষের প্রাণহানি ও কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গতকাল ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এই তথ্য বলছে, পাঁচজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮৩২ জন। আহতদের মধ্যে নড়াইলেই ৭২৮ জন। যদিও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী সাত জেলায় গাছের ডাল পড়ে, ঘরচাপায় ও পানিতে ডুবে ৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে বরগুনায়। সেখানে ৭২৫টি ঘর সম্পূর্ণভাবে এবং সাড়ে ৮ হাজার ঘরবাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতি হয়েছে। খুলনায় ৯৯০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ও ৩ হাজার ৬৫০টি ঘরবাড়ি আংশিক, নোয়াখালীতে ৪০০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ও ২২৫টি ঘরবাড়ি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অন্য ঘরবাড়িগুলো লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, ঝালকাঠি জেলার।

তিন জেলায় ১ হাজার ৮৩০ একর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে এবং মোট ১৫টি জেলায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৩২ একর জমির ফসল আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে। জেলার ১ হাজার একর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ও ৩ হাজার একরের ফসল আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কক্সবাজারের ৫০০ একর ও ফেনীতে ৩৩০ একর জমির ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিকভাবে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া জেলাগুলোর মধ্যে আছে নড়াইল, ভোলা, বরিশাল, যশোর, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী।

দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৭৫টি গবাদিপশু মারা গেছে। কক্সবাজার, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ফেনী, নোয়াখালী ও খুলনায় মোট ৫৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রায় ২২ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে পটুয়াখালীতে ১০ কিলোমিটার ও সাতক্ষীরায় ৫ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাত থেকে রক্ষা করতে প্রায় পৌনে ১৭ লাখ মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বা নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। তারা নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে গেছে।

সুনামগঞ্জে তিন বাঁধ ভেঙেছে

সুনামগঞ্জ থেকে প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদক খলিল রহমান জানিয়েছেন, শনিবার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রক্তি নদীতে উজান থেকে ঢল নামে। এতে দুই ঘণ্টায় নদীর পানির উচ্চতা পাঁচ থেকে ছয় ফুট বেড়ে যায়। এতে খরচার হাওরের চাতলপাড় এলাকায় ফসল রক্ষা বাঁধ উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করতে থাকে। গ্রামবাসী রাতে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

কৃষক আবু হানিফ (৫১) বলেন, গভীর হাওরে ধান কাটা শেষ হলেও হাওরের উঁচু এলাকায় এখনো ধান রয়েছে। যেভাবে পানি ঢুকছে, কালই (আজ সোমবার) সব ধান তলিয়ে যাবে।

শনিবার রাতে জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের বেহেলী এলাকার ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে। সেটিও চেষ্টা করে রক্ষা করা যায়নি। নিতাইপুর এলাকায় আরেকটি বাঁধ ভেঙে শনির হাওরে পানি ঢোকে। তবে শনির হাওরের আনোয়ারপুর এলাকায় আরেকটি বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ শুরু করলে সেটি মেরামত করা হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বশির আহমদ সরকার বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরের ধান কাটা প্রায় শেষ। এখন যে ধান কাটা বাকি আছে, তা হাওরের উঁচু জমিতে। শনিবার রাত থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকেরা হাওরের ধান কাটছেন। সুনামগঞ্জে এবার ২ লাখ ২৪ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়।

খুলনায় আবারও বাঁধ ভেঙেছে

খুলনা থেকে প্রথম আলো প্রতিনিধি জানান, পশুর নদের দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়নের বাজার এলাকার বেড়িবাঁধ গতকাল আবারও ভেঙেছে। সকালে ওই এলাকার বাঁধ ভেঙে লোনা পানি ঢুকে পড়ে। অবশ্য স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় বিকেলে বাঁধ মেরামত করা হয়। এ নিয়ে ১৫ দিনে তিনবার এই বাঁধ ভাঙে। স্থানীয়রা আবারও বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা করছেন।