বয়সকাঠামোর সুযোগ চিরস্থায়ী নয়

এ কে এম নূরুন–নবী
এ কে এম নূরুন–নবী

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে আর্থসামাজিক অনেক সূচকে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। দেশে যুব জনগোষ্ঠী বেড়েছে। জনসংখ্যার অতি দ্রুত বেড়ে চলাকে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।

তারপরও বাংলাদেশের আয়তন বা মাথাপিছু ভূমির পরিমাণের কথা মাথায় রাখতে হবে। ছোট একটি দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বসতি। দেশলাইয়ের বাক্সে কাঠির মতো এখানে মানুষ ঠাসাঠাসি করে থাকে। এটা সুস্থ পরিবেশ না। অল্প জায়গায় বেশি মানুষের সুস্থভাবে বসবাস করতে পারাটাই জাতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

উন্নত দেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি। উন্নত দেশের মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ১৭-১৮ হাজার ডলার। ওই স্তরে পৌঁছাতে আমাদের আয়কাঠামোতে বদল আনতে হবে। আমাদের জনসংখ্যার কাঠামোতে একটি পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে।

এখন জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম। অর্থাৎ এখন অন্যের আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ কম। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ব্যাপারটা ছিল ঠিক উল্টো। বয়সকাঠামোর এই পরিবর্তন আমাদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে। একেই বলা হচ্ছে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। একে ‘অর্থনৈতিক ডিভিডেন্ড’-এ রূপান্তর করা বড় চ্যালেঞ্জ।

এর অর্থ হচ্ছে কর্মক্ষম মানুষকে কাজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। মানুষকে মানবসম্পদে পরিণত করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল দেশে ব্যবহার করতে হবে, বিদেশে পাঠাতে হবে।

এসএসসি পাস করা যুবক হয়তো মাঠে হাল চাষ করতে চাইবেন না। কিন্তু তাঁকে যদি বলা হয়, মাঠে ফসল ফলাতে হবে এবং প্রতি মাসে তাঁকে বেতন দেওয়া হবে, তিনি হয়তো কাজটি চাকরি হিসেবে গ্রহণ করবেন। তবে তাঁকেও মাঠের কাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে।

জনসংখ্যার বয়সকাঠামোর এই সুযোগ কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একটা দেশের জন্য এই সুযোগ একবারই আসে। ৩০–৩৫ বছর এই সুযোগ থাকে। এটা মৌসুমি বায়ুর মতো। শুষ্ক বায়ুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়।

এটাও মনে রাখতে হবে যে দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষ বাড়ছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২৫ সালে ১০ জনে ১ জন থাকবে প্রবীণ, ২০৫০ সালে ৫ জনে ১ জন। চাই বা না চাই বয়স্ক মানুষ বাড়বে। অর্থাৎ অন্যের আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষ বাড়বে। জাপানে এটা হয়েছে, ইউরোপের প্রায় সব দেশেই এটা হয়েছে।

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অবসরে যায়। অনেকে কর্মক্ষম থাকেন না। তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকেন। তাঁদের বড় অংশ জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন। তাঁদের সেবায় ব্যয় বেশি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

প্রবীণদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে। যত দূর সম্ভব আর্থসামাজিক কাজে তাঁদের যুক্ত রাখতে হবে। তাঁদের চিকিৎসা ও সেবার জন্য উপযুক্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান আর লোকবল তৈরি করতে হবে।

পরিকল্পনা দরকার নগরায়ণ নিয়েও। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন বাড়ছে। মানুষ মূলত জড়ো হচ্ছে ঢাকা শহরে। বিকল্প শহর চাই। বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করতে হবে। নয়তো বিকেন্দ্রীকরণ কাজে আসবে না।