ভবদহের ৬৫৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাতিল দাবি

ভবদহ অঞ্চলের কোনো বিলে জোয়ারাধার চালু না থাকায় সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে উঁচু হচ্ছে শ্রী, হরি ও টেকা নদীর বুক। ছবিটি ভবদহ স্লুইসগেট-সংলগ্ন শ্রী নদী থেকে সম্প্রতি তোলা । প্রথম আলো
ভবদহ অঞ্চলের কোনো বিলে জোয়ারাধার চালু না থাকায় সাগর থেকে জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি জমে উঁচু হচ্ছে শ্রী, হরি ও টেকা নদীর বুক। ছবিটি ভবদহ স্লুইসগেট-সংলগ্ন শ্রী নদী থেকে সম্প্রতি তোলা । প্রথম আলো

যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে নেওয়া প্রকল্পকে ‘ক্ষতিকর, পরিবেশ ও জনবিরোধী এবং অবাস্তব প্রকল্প’ বলে দাবি করেছে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি। তারা এ প্রকল্প বাতিল করে বিল কপালিয়াসহ এলাকার অন্যান্য বিলে পর্যায়ক্রমে জোয়ারাধার (টিআরএম-টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট) প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।

আজ সোমবার এই কমিটি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়। যশোর শহরের নীল রতন ধর রোডে সংগ্রাম কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় এই সম্মেলন হয়।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ কুমার বাওয়ালী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন। বক্তব্যে বলা হয়, গত ১২ সেপ্টেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যাচাই–বাছাই কমিটিতে বিল কপালিয়ায় প্রস্তাবিত টিআরএম প্রকল্প বাতিলের ঘোষণা যশোরবাসীর জন্য এক মহাবিপৎসংকেত বহন করছে। জলাভূমি রক্ষার যুক্তিতে বিল কপালিয়া টিআরএম বাতিল করা হয়েছে, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

বাওয়ালী বলেন, ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন করে ৬৫৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা করা হয়েছে। প্রকল্পটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাসের অপেক্ষায় রয়েছে। সংশোধিত ডিপিটিতে ১০৭ দশমিক ৯০ কিলোমিটার নদী পুনঃখনন, ৩০ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং, ৬২টি খালের ২৬৪ দশমিক ৫১ কিলোমিটার পুনঃখনন, বিভিন্ন খালের ওপর ১৯টি কালভার্ট নির্মাণ, ৫০ দশমিক ২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, একটি স্লুইসগেট নির্মাণ ও ১৯টি স্লুইসগেট মেরামত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ভবদহ জলাবদ্ধতার নিরসনে সবচেয়ে কার্যকর টিআরএম ডিপিপিতে রাখা হয়নি। বিষয়টি চরম উদ্বেগের।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গত ১৮ জুলাই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার ভবদহ পরিদর্শনে এসে কতিপয় চেয়ারম্যানদের সামনে ঘোষণা দেন, জোয়ারাধার ভবদহ জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানের কোনো পথ নয়। এতে জলাশয় নষ্ট হবে। সমস্যা সমাধানে নদী-খাল কাটতে হবে। এরপর টিআরএম বাতিল করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়, নদী কেটে নদী বাঁচানো যায় না, নদীর প্রবাহ নিশ্চিত করেই কেবল নদী বাঁচানো সম্ভব। নদী বাঁচাতে সাগর থেকে উঠে আসা পলি বিলে বিলে ধারণ এবং উজানের পানিপ্রবাহের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। চার বছর ধরে কেবল নদী কাটার নামে প্রহসন করা হচ্ছে। যতবার যন্ত্র দিয়ে পলি কেটে তোলা হয়েছে, ততবার জোয়ারে সাগর থেকে পলি উঠে নদী ভরাট করে দিয়েছে। এতে নদীর অবস্থা ক্রমে খারাপ হচ্ছে। এই বছর নদীগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার নদী পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। সমস্যা সমাধানে টিআরএমের কোনো বিকল্প নেই।

আন্দোলনকারীরা বলেন, এটা খুবই হতাশাজনক এবং গণবিরোধী যে ৬৫৫ কোটি টাকার নতুন যে প্রকল্প চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা এই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদী ও ভূমি সম্পর্কিত জনগণের অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের বিজ্ঞানসম্মত মতামতের পরিপন্থী। এতে রাষ্ট্রের অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। মহলবিশেষ এই অর্থ লোপাটের সুযোগ পাচ্ছে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ডেল্টা প্ল্যান–২১০০ গৃহীত হওয়ার পরপর ভূমি রক্ষার অজুহাতে টিআরএম প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে, তা আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রাকৃতিক জলাভূমি রক্ষা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু একমাত্র রেকর্ডীয় নদী–খাল ব্যতিরেকে ভবদহ এলাকার কোনো অংশ আদৌ রাষ্ট্রের কোনো তালিকাভুক্ত জলাভূমির আওতায় পড়ে না। মুক্তেশ্বরী, হরি, টেকা ও শ্রী নদীর অববাহিকার যে অংশ ভবদহ-ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল বলে পরিচিত, তা মূলত অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও যশোর সদর উপজেলার লাগোয়া ভূভাগ। এই অঞ্চল নিকট অতীতেও দোফসলি–তিন ফসলি জমি হিসেবে চাষাবাদ হয়ে এসেছে। এরূপ দোফসলি–তিন ফসলি জমিকে জলাভূমি বলে চালিয়ে দেওয়া কোনো শুভবুদ্ধির লক্ষণ নয়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকারের পানিবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা আইডব্লিউএম(ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং) পরীক্ষা–নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ–পর্যালোচনা ও জনগণের মতামত যাচাইয়ের পর বিল কপালিয়াসহ পর্যায়ক্রমে টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করে। এর ভিত্তিতে সরকার বিল কপালিয়ায় টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করে। অথচ এবার একটি বহুচর্চিত বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প গ্রহণের আগে জনমত যাচাইয়ের কোনো প্রয়োজনই বোধ করা হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ, প্রধান সমন্বয়ক বৈকুণ্ঠ বিহারী রায়, যুগ্ম সমন্বয়ক গাজী আবদুল হামিদ, সদস্যসচিব চৈতন্য কুমার পাল, মহেন রায়, সনজিত বিশ্বাস, মাসুদ হাসান, ভগীরথ হালদার, রাজু আহমেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।