যমুনায় বেড়েছে পানি, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

সিরাজগঞ্জে বন্যায় ডুবে গেছে বাঐতারা গ্রাম। গতকাল বুধবার দুপুরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
সিরাজগঞ্জে বন্যায় ডুবে গেছে বাঐতারা গ্রাম। গতকাল বুধবার দুপুরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পানি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় জেলার ছোট–বড় ১০টি শাখা নদীতেও পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে শুরু করেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতরে থাকা জেলার হুরাসাগর, বিলসূর্য, করতোয়া ও ফুলজোর নদেও পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমি। দেখা দিচ্ছে গবাদিপশুর খাদ্যসংকট।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, গত সোমবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে ১৪ দশমিক ২৯ মিটার রেকর্ড করা হয়েছে। বর্তমানে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জেলার চরাঞ্চলসহ নতুন নতুন এলাকার ফসলি জমি পানিতে ডুবে গেছে। শাহজাদপুর, এনায়েতপুরের ব্রাম্মনগাতী, আড়কান্দি, হাটপাচিল এবং কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, বাঐখোলা পাটাগ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীগর্ভে চলে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ। অনেকে বাড়িঘর নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে বাঁধের পাশে আশ্রয় নিচ্ছে। বেশ কয়েকটি উপজেলার বাসিন্দারা বন্যা–আতঙ্কে ভুগছেন। সিরাজগঞ্জ পাউবো বলছে, আরও দু–এক দিন যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে জেলা প্রশাসন বন্যা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ।

প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানির গতি বৃদ্ধির তীব্রতায় ভয়াবহ বন্যা–আতঙ্কে রয়েছেন যমুনার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের মানুষ। ইতিমধ্যেই সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, কাজীপুর, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার নতুন নতুন এলাকায় বাড়িঘর ও আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। শাহজাদপুরে বিস্তীর্ণ ঘাসের জমি তলিয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন গোখামারিরা।

কথা হয় শাহজাদপুর উপজেলার রেশমবাড়ি গ্রামের গোখামারি হাসেম আলী, রহমান শেখ ও আবদুর রহিমের সঙ্গে। হাসেম আলী বলেন, ‘এমনিতেই দুধের চেয়ে ভুসির দাম বেশি, তার ওপর আবার বন্যায় আমাদের সব ঘাসের জমি সব ডুবে গেছে। এখন শুধু ভুসির ওপর গাভির খামার টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, এক সপ্তাহ ধরেই যমুনার পানি চরাঞ্চলে ঢুকছে। ফসলি জমি ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে। সোমবার সকাল পর্যন্ত মেছড়া ইউনিয়নের শত শত একর ফসলি জমি ও বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

এদিকে গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে কাজীপুরের একটি রিংবাঁধ ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে নতুন করে পাঁচটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহিদ হাসান সিদ্দিকী বলেন, বন্যাপ্লাবিত এলাকার মানুষের মধ্যে ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। জনগণের সুবিধার্থে টিউবওয়েল ও অস্থায়ী শৌচাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।

এদিকে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার বন্যাপ্লাবিত শুভগাছা, হাটবয়রা, মেছরা, কাওয়াকোলা, গোটিয়ার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ৯০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার, সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফিরোজ মাহমুদ ও কাজীপুর ইউএনও সরকার মোহাম্মদ রায়হান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিরাজগঞ্জে পাউবোর অতিথিশালায় এক সংবাদ সম্মেলনে সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, বন্যা মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। কাজেই বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কারও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এখন পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো সুরক্ষিত আছে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিরাজগঞ্জ পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, যমুনায় পানি বৃদ্ধির তীব্রতা অব্যাহত রয়েছে। কয়েক দিন ধরেই আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পানি। তিনি আরও বলেন, বন্যার পানি আরও দু–এক দিন বাড়তে পারে। তবে এখন পর্যন্ত ৭৯ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ছোটখাটো ছিদ্র ছাড়া বড় কোনো বিপর্যয় হয়নি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ডিডি) মো. হাবিবুল হক বলেন, জেলার প্রায় ৬ হাজার ৪০০ হেক্টর পরিমাণ ফসলি জমিতে পানি উঠেছে। এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পরিমাপ করা যায়নি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুর রহিম বলেন, যমুনার পানি বাড়ার তীব্রতার কারণে চরাঞ্চলের গ্রামগুলোয় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এ পর্যন্ত জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ১৮১টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের ২১ হাজার ৫৫২ পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৪৯৪ টন চাল ও আট লাখ টাকা রয়েছে। এগুলো বিতরণের প্রক্রিয়া চলমান।