সুন্দরবনের বাঘ বৈচিত্র্যময়

দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বেঙ্গল টাইগার আছে প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশ সুন্দরবনে আছে ১১৪টি ও ভারতীয় সুন্দরবনে ৮৪টি। বাকিরা ভারতের অন্য বনাঞ্চলে এবং নেপাল ও ভুটানে থাকে। যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেঙ্গল টাইগারের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ বৈচিত্র্যময় এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা বেশি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজ কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, জিনগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সুন্দরবনের বাঘের তিনটি ধরন (হেপলোটাইপ) আছে। ভারতে দুই, নেপাল ও ভুটানে এক ধরনের বেঙ্গল টাইগার আছে। জিনগত বৈচিত্র্যের কারণে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সুন্দরবনের বাঘ এখনো টিকে আছে।

গবেষণাটিতে আরও যুক্ত ছিলেন বন্য প্রাণিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্যানথেরার গবেষক টোলা স্মিথ ও জন হুডরিচ, কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেইডেন জ্যাকসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম। গবেষণার ফলাফলটি একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনের বাঘের মধ্যে যে তিন ধরনের হেপলোটাইপ আছে, তার কারণেই এই বাঘ এমন একটি জলা ও কাদাময় পরিবেশের মধ্যে প্রায় ৩০০ বছর ধরে টিকে আছে। মানুষের উৎপাত না হলে তারা এখানে আরও হাজার বছর টিকে থাকবে। অন্যান্য বনের সঙ্গে এই বনের বাঘের প্রজনন সম্পর্ক না হওয়ায় এর স্বাতন্ত্র্য টিকে থাকবে। তবে এর কিছু ঝুঁকিও আছে। জিনগতভাবে এটি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। ফলে ভারতীয় সুন্দরবনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘের নির্বিঘ্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বাঘের বসতি এলাকা সুন্দরবনের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে।

>

কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা
জিনগত বৈচিত্র্যের কারণে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সুন্দরবনের বাঘ এখনো টিকে আছে

বিশ্বের বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাভূমি ও কাদামাটির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবন বেঙ্গল টাইগারের বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। ২৫০ থেকে ৩০০ বছর আগে বাংলাদেশের শুষ্ক ভূভাগ থেকে সুন্দরবনে গিয়ে এরা বসবাস শুরু করে। বিশ্বে বাঘের যে ছয়টি উপপ্রজাতি এখনো টিকে আছে, তার সব কটি মূলত শুষ্ক এলাকায় থাকে। আর তাদের খাবার বা প্রে অ্যানিমেলও অনেক বেশি। ভারতের আসামে কাজীডাঙা বনভূমি ও উত্তরাখন্ডের করবেট সংরক্ষিত বনে বাঘের খাবারের জন্য পাঁচ থেকে ছয় প্রজাতির বড় আকৃতির প্রাণী আছে। যেমন মহিষ, শম্বর, হরিণ, শূকর, বানর, গরু ও ছাগল রয়েছে। সেখানকার বাঘ এসব বড় আকৃতির প্রাণী খেয়ে বড় হয়। ফলে তাদের আকৃতিও বেশ বড় হয়। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘের জন্য হরিণ ও বুনো শূকর ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী খাবার হিসেবে নেই।

বন অধিদপ্তরের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সুন্দরবনকে মূলত পশুর ও শিবসা নামের দুটি নদ-নদী ভাগ করেছে। মূলত ওই নদীর কারণেই বাঘের তিনটি ধরন তৈরি হতে পারে।

অধ্যাপক আজিজের গবেষণায় বাঘের মল, লোম, মৃত বাঘের কোষ সংগ্রহ করে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিএনএ ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে ভারতের বাঘ বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অতিথি জ্যেষ্ঠ ফেলো অনুরাগ ডান্ডা প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের গবেষণাতেও এই বাঘের একই ধরনের বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে। আবার অন্য দিক থেকে কয়েক শ বছর ধরে এরা সুন্দরবনের ভেতরে আটকে থাকায় বেশ কিছু ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। যেমন সুন্দরবনের পাশে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ায় আগের চেয়ে অনেক বেশি এলাকা জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে। ফলে ভারত ও বাংলাদেশকে যৌথভাবে সুন্দরবন রক্ষায় কাজ করতে হবে।

আজ বিশ্ব বাঘ দিবস। এবারের বাঘ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘বাঘ বাঁচাতে শপথ করি, সুন্দরবন রক্ষা করি’।