রাজধানীর এক সবুজ হৃৎপিণ্ড

বলধা গার্ডেনের পুকুরটিতেই ছিল শুধু রোদ, বাদবাকি সবখানে ছায়া।  ছবি: জাহিদুল করিম
বলধা গার্ডেনের পুকুরটিতেই ছিল শুধু রোদ, বাদবাকি সবখানে ছায়া। ছবি: জাহিদুল করিম

রাস্তায় ছিল প্রখর রোদ। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় বসে গরমে অতিষ্ঠ হতে হতে ওয়ারীর বলধা গার্ডেনে যাওয়া। বলধার দুই অংশ—সাইকি ও সিবিলি। সাইকি বন্ধ। টিকিট করলাম আমরা সিবিলির। ২০ টাকার টিকিটে গেট দিয়ে ঢুকতেই মনে হলো, আমরা যেন অ্যালিসের মতো ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঢুকে পড়েছি। প্রখর রোদ ততক্ষণে বলধার নিয়ন্ত্রণে। সবুজ গাছের সংস্পর্শে এসে রোদ যেন হারিয়ে ফেলেছে তার পৌরুষ। যারা বাগানে ঢুকেছে, তারা যেন কিছুক্ষণের জন্য ২০ টাকা দিয়ে প্রাকৃতিক শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কিনে ফেলেছে। হ্যাঁ, বলধা গার্ডেনজুড়ে তখন ছায়া।

রাস্তার কোলাহলের পর এ রকম নিস্তব্ধতার মধ্যে যখন কানকে শান্তি দিয়ে পাখি ডাকতে শুরু করল, তখন মনে হলো, নাহ্! কথায় কথায় ‘যান্ত্রিক’ ঢাকা শহরের পিণ্ডি চটকানো ঠিক নয়। অনিন্দ্যসুন্দর কিছুর দেখা এখানেও তো মেলে।

ওই যে পুকুরের ওই পাড়ে সারি সারি সিঁড়ি, তার একটায় বসে আছে এক প্রেমিক যুগল। ‘আপত্তিকরভাবে’ কেউ এসে এখানে বসলে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হবে, এমন সাবধানবাণী আছে বাগানের নানা জায়গায়। কিন্তু খুব কাছাকাছি যে ছেলেটা আর মেয়েটা বসে বসে কথা বলছিল, তাদের দেখে মোটেও আপত্তিকর লাগছিল না। পুলিশ ডাকার মতো কোনো কারণ এখানে ঘটেনি।

প্রতিটি গাছেই নাম লেখা। কয়েকটি বলেই ফেলি—উদয় পদ্ম, গার্ডেনিয়া। এরপরের নামটি দারুণ—লাইলী মজনু। এই গাছের পাতার রং একটু মেরুন আর একটু সবুজ। এরপর সেই সারিতেই এরিকা পাম, কনকচাঁপা, রামধামচাঁপা, আকরকাটা। বড় একটা গুস্তাভাগাছের পরই তেঁতুলগাছ। আরও কত গাছ! এখানকার সংরক্ষিত এলাকার গাছগাছালির পরিচর্যা করেন মো. হাফিজুল ইসলাম। এখানে সময় কাটাতে তাঁর খুব ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে? ‘লোকজন আসে। গাছ দেখে, এটাই আনন্দ।’

দেবদারুর পাশে অর্জুন, তারপর কানাঙ্গা। এরপর যে সাইকাসগাছ, তারই নিচে বসে আড্ডা মারছেন তিন যুবক—মো. ঝন্টু, মো. লুৎফর রহমান শেখ ও হাবিবুর রহমান। সামনের এক নির্মীয়মাণ বাড়িতে রঙের কাজ করেন তাঁরা। আজই প্রথম এসেছেন বলধায়। তাঁদের মনে তখন মুক্তির আনন্দ। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেসমিন আখতার, বিবলি আর ফারজানা আখতারকে নিয়ে এসেছেন ঢাকার বন্ধু সোহেল। বিভিন্ন বয়সী তিন নারী আর এক পুরুষ যেভাবে বলধাকে আপন করে নিলেন, তাতে মনে হলো, শান্তির ঠিকানা আসলে খুব দূরে নয়।

ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী যখন ১৯০৯ সালে বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন কি জানতেন, একসময় ঘনবসতি হবে এই এলাকা বাগানটির ভেতরে না এলে কেউ জানতেও পারবে না, ইট–কাঠ–কংক্রিটের শহরে এ রকম সবুজ এক হৃৎপিণ্ড আছে। নরেন্দ্র নারায়ণ চেষ্টা করেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দুর্লভ প্রজাতির গাছ আনতে। তাঁর মৃত্যুর পর এই বাগান যেন স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে এটির দায়িত্ব নেয় সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বন বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধের পর আবার গাছে গাছে সজীব হয়ে ওঠে বাগান। গড়ে ওঠে দুটি গ্রিনহাউজ। শঙ্খনিধি পুকুরটিতে সব সময় পানি থাকত না। এখন থাকে। পুকুর আর গাছের ছায়া মিলেমিশে যেন অপার্থিব এক সংগীতের জন্ম দেয়, যার তাল–লয়ে বাঁধা পড়ে যায় বলধায় আসা প্রত্যেক মানুষ।