সোয়া ঘণ্টার বৃষ্টিতে ডুবল ঢাকা

এক ঘণ্টার মুষলধারের বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে বিকল হওয়া যানবাহনের কারণে তৈরি হয়েছে যানজট। পানি ভেঙে চলতে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। গতকাল বিকেল চারটায় রাজধানীর মিরপুর রোডে।  ছবি: জাহিদুল করিম
এক ঘণ্টার মুষলধারের বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে বিকল হওয়া যানবাহনের কারণে তৈরি হয়েছে যানজট। পানি ভেঙে চলতে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। গতকাল বিকেল চারটায় রাজধানীর মিরপুর রোডে। ছবি: জাহিদুল করিম

বৃষ্টি হলেই রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতা এবং মানুষের ভোগান্তি গত কয়েক বছরের নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু চলতি বছরের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার ভোগান্তির মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। মাত্র সোয়া ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল গোটা রাজধানী। ডুবে গিয়েছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়কসহ অলিগলি। অনেক এলাকার ফুটপাতও ছিল পানির নিচে।

এসব রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে ছিল ছোট-বড় নানা ধরনের যানবাহন। হেঁটে যেখানে যেতে ১০ মিনিট লাগে, গাড়িতে সেই জায়গায় যেতে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগেছে। ফলে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। এটি নিরসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো, বিশেষ করে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়াবিদদের ভাষায় এটি মাঝারি মাত্রার বৃষ্টি। আর বেলা ১টা থেকে ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৩৫ মিলিমিটার। মূলত এই ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট বৃষ্টির প্রভাব পড়ে রাজধানীজুড়ে।

প্রথম আলোর সাতজন প্রতিনিধি শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রায় সব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখতে পান। তবে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা ছিল খুবই বেশি। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধানমন্ডি ২৭। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘নদীর নাম ধানমন্ডি ২৭’। এ ছাড়া মিরপুর রোড, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউর বিভিন্ন অংশ, আসাদ গেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, তেজতুরী বাজার, কারওয়ান বাজার, রায়েরবাজার ও হাজারীবাগ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাজুড়ে ঘরে ফেরা মানুষের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টন, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা থেকে শুরু করে সংলগ্ন এলাকায় রাত আটটা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ভেতর–বাইরে ছিল প্রায় হাঁটুপানি। বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও দর্শনার্থীদের গাড়িতে উঠতে হয়েছে পা ভিজিয়ে। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সচিবালয় থেকে ভিজে বের হয়ে বাইরে গিয়ে গাড়িতে উঠতে দেখা যায়।

>

দু-তিন বছর আগে ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও জলাবদ্ধতা হতো না। কাল ৩৫ মিলিমিটারেই ঢাকা ডুবেছে।

নগর–পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর থেমে থেকে বৃষ্টি হয়েছে। তাই জলাবদ্ধতার তীব্রতা চোখে পড়েনি। কিন্তু গতকাল টানা ও ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি দেখা গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, প্রায় সোয়া ঘণ্টায় মাত্র ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ দু-তিন বছর আগেও ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা হতো না। এতে বোঝা যাচ্ছে, পানিনিষ্কাশন পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে।

শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে তাঁর বক্তব্যের যথার্থতা পাওয়া যায়। পুরান ঢাকার বংশাল ও বাংলাবাজার, জুরাইন, যাত্রাবাড়ীর কাজলা, গুলশানের শুটিং ক্লাব মোড়, তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, কাকরাইল, বিমানবন্দর সড়কে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানি জমে ছিল। ওই সব এলাকা ও রাস্তায় যান চলাচলের গতি কমে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। শহরের বিভিন্ন সড়কে পানিতে ডুবে বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, বাসসহ নানা যানবাহন। এ কারণে যানজটের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।

পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও খারাপ হওয়ার পেছনে শহরে বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজের কারণে পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া, নালাগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করা, খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তরা। তাঁরা বলছেন, রাস্তা থেকে নদী পর্যন্ত পানি যাওয়ার প্রক্রিয়াটি নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। এ জন্য ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। পাশাপাশি নালা ও খালে যাতে ময়লা-আবর্জনা না ফেলা হয়, সে ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।

গতকাল দুপুরে রায়েরবাজার, আজিমপুর, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ফুলবাড়িয়া, মৎস্য ভবন, শাহবাগ হয়ে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ঘুরে ওই সব এলাকার প্রায় সব রাস্তা পানিতে ডুবে থাকতে দেখা যায়।

ঘড়িতে যখন বেলা পৌনে দুইটা, তখন একজন প্রতিবেদক ছিলেন মৎস্য ভবনের সামনে। সেখান থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে যায় শাহবাগ মোড় পার হতে। ওই মোড়ে কয়েক শ মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সেখানে কথা হয় আবদুল্লাহ আল মামুন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। কিন্তু অবস্থা এমন ভয়াবহ হবে, তা বুঝতে পারিনি। বাসে উঠে আধঘণ্টায় ১০ কদমও আগাতে পারিনি। তাই নেমে এসেছি। হেঁটে মহাখালীতে যাব।’

গতকাল কিশোর আলোর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন তানজিমা সুলতানা। তিনি জানান, ব্যক্তিগত গাড়িতে বেলা দেড়টায় তিনি মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি থেকে রওনা দেন। কারওয়ান বাজারে যখন পৌঁছান, তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা।

গতকাল মিরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে কর্মস্থলে এসেছিলেন গৌতম মণ্ডল। জলাবদ্ধতার ভোগান্তি সম্পর্কে তিনি বললেন, ‘মনে হলো যেন সাঁতার কেটে এলাম।’

আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঢাকায় বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটি আরও চার-পাঁচ দিন চলতে পারে। তবে আজ বুধবার বৃষ্টি হতে পারে থেমে থেমে।

গতকালের জলাবদ্ধতা সম্পর্কে ঢাকা ওয়াসার পর্যবেক্ষণ জানতে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে সংস্থাটির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেছেন, একসঙ্গে বেশি বৃষ্টি হওয়ায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। জলাবদ্ধতা তিন–চার ঘণ্টা ছিল।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজটি একই সূত্রে গাঁথা। আমরা সমস্যাগুলো জানি। এগুলো সমাধানে সমন্বয়ের মাধ্যমে দুই সংস্থাকে অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির কিছু পদক্ষেপের কথা জানান তিনি। জলাবদ্ধতা আগের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে—এ বিষয়ে মেয়র মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনকে ফোন করে তাঁকে পাওয়া যায়নি।‍