জলাশয়ে জ্বলজ্বল সাদা পদ্ম

জলাশয়ে ফুটে আছে সাদা পদ্ম। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের মাগুড়া গ্রামে।  প্রথম আলো
জলাশয়ে ফুটে আছে সাদা পদ্ম। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের মাগুড়া গ্রামে। প্রথম আলো

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। কুয়াশার চাদর সরিয়ে ঝলমলে রোদ আলো ছড়াতে শুরু করেছে পথঘাট, খেত—সবখানে। সেই আলোয় জলাশয়ের ওপর বিছানো সবুজ পাতা ভেদ করে জ্বলজ্বল করে ওঠে সাদা সাদা একেকটি পদ্ম।

জলাশয়জুড়ে জলে ভাসা পদ্ম দেখে পথচারীরা আকৃষ্ট হন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটুখানি দাঁড়িয়ে চোখজুড়ানোর লোভ সামলাতে পারেন না তাঁরা। আর তা দেখে প্রাণ জুড়ান জলাশয়ের মালিক ওসমান গনি।

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার মাগুড়া গ্রামে ওসমান গনির বাড়ি। বাড়ির পাশেই তাঁর পদ্ম ফুলের এই জলাশয়। এতে ভেসে থাকা সাদা পদ্ম, আর তার ওপর পাখপাখালির ওড়াউড়ি এখন ওই এলাকার মানুষের আনন্দের উৎস হয়ে উঠছে।

পদ্ম বহুবর্ষজীবী একটি উদ্ভিদ। সারা বছর পানি থাকে এমন জায়গায় পদ্ম ভালো জন্মে। তবে শুষ্ক মৌসুমে খাল-বিল, হাওর, বাঁওড়েও এ উদ্ভিদ জন্মে থাকে। এর কাণ্ড লতানো। পাতা গোলাকার। সরু কাঁটাযুক্ত লম্বা বোঁটার ফুলগুলো সুগন্ধিযুক্ত। পাপড়ি সাদা ও পুংকেশর হলদেটে। একটি ফুলে ১২ থেকে ১৮টি পাপড়ি থাকে। বর্ষা থেকে শরৎকালে এ ফুল বেশি ফোটে।

এই ফুলের ফল দেখতে বাটির মতো, রং সবুজ। ফলের ভেতর বাদামি রঙের বীজ। পানির ওপরে পাতা ও ফুল ভাসমান থাকে। মূল পানির নিচে কাদায় আবদ্ধ থাকে।

ওসমান গনি বলেন, জলাশয়টি সারা বছরই পড়ে থাকে। ২০ বছর আগে সেখানে প্রথম দু–একটি পদ্মলতা দেখা যায়। পরে দ্রুত বংশবিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে গোটা জলাশয়ে। তিনি বলেন, পদ্মের টানে এখানে প্রতিবছর প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে আসেন। তাঁর বাড়ির পাশের গাছতলায় বসে তাঁরা পদ্মের সৌন্দর্য উপভোগ করেন। অনেকে পদ্ম ফুল তুলে ফিরে যান নিজ নিজ গন্তব্যে।

সম্প্রতি এক সকালে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ জলাশয়টি সাদা সাদা পদ্ম ফুলে ভরা। চারপাশের সবুজ পদ্মের পাতায় ঘেরা। পতঙ্গ আর ছোট ছোট পাখি উড়ে গিয়ে ভেসে থাকা পদ্ম ফুল ও পাতার ওপর বসছে। পাতায় জমে আছে টলটলে শিশিরকণা। সূর্যের আলো পড়তেই তা জ্বলজ্বল করে উঠছে। খানিক বাতাসের দোলায় শিশিরকণা গড়িয়ে পড়ছে জলাশয়ে। সূর্যের আলো তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে নানা রূপ নেয় জলাশয়টি।

স্থানীয় বাসিন্দা সোলেমান আলী বলেন, ‘এই জলাশয়ে অনেক আগ থেকেই পদ্ম ফুল ফোটে। এবার বেশি ফুল ফুটেছে। এখানে ফসল চাষাবাদ না করার কারণে পদ্মের দ্রুত বংশবিস্তার ঘটেছে। যখনই সময় পাই, সেখানে গিয়ে সময় কাটাই।’

জলাশয়ে নেমে পদ্মচাক (বীজ) সংগ্রহ করতে দেখা যায় কয়েকটি শিশুকে। তাদের মধ্যে মো. শাহিন জানায়, পদ্মবীজ খেতে খুব সুস্বাদু। তারা এ বীজের নাম দিয়েছে ‘বাদামদানা’। 

গত রোববার ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের লক্ষ্মীপূজা। লক্ষ্মীপূজায় লাগে পদ্মের অঞ্জলি। তাই এ সময় পদ্মের চাহিদা ছিল তুঙ্গে। শহরের কালীবাড়ি বাজারে পদ্ম ফুলের পসরা নিয়ে বসেছিলেন বিক্রেতা নিখিল রায় (৫২)। তিনি প্রতিটি পদ্ম বিক্রি করছিলেন পাঁচ টাকা করে। নিখিল রায় বলেন, ‘এসব ফুল হরিপুরের জলাশয় থেকে সংগ্রহ করা। দুর্গাপূজা ও লক্ষ্মীপূজার সময় এই জলপদ্ম পাওয়া যায়। আমরাও এই সময় পদ্ম ফুল বেচে কিছু আয় করি।’

পদ্মের রয়েছে নানা ঔষধি গুণও। প্রবল জ্বরে পদ্মপাতার ওপর শুয়ে থাকলে জ্বরের প্রকোপ কমে। পদ্ম ফুলের ভেতরে থাকা বীজে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা দেহের ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে সহায়তা করে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এটি যেমন উপকারী, তেমনি দেহের ওজন কমাতেও সহায়ক। ফলের বীজ হৃৎপিণ্ড, চর্মরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বেশ উপকারী। এ ছাড়া পদ্মচাক বা বীজ সুস্বাদু খাবার। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক আফতাব হোসেন বলেন, ‘এলাকায় পদ্ম ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাইলে এটি অর্থকরী হতে পারে। কৃষকেরা উদ্যোগ নিলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’