নতুন সড়ক আইন কার্যকরে বিআরটিএ বেকায়দায়

পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। নতুন আইনে মোটরযানের নিবন্ধন, চালকের লাইসেন্স পরীক্ষার পদ্ধতি, মোটরযানের ফিটনেস সনদের মেয়াদ, গণপরিবহনের চলাচলের অনুমতির (রুট পারমিট) বিষয়গুলো স্পষ্ট নয়। বিধিমালার মাধ্যমে এগুলো পরিষ্কার করার সুযোগ থাকলেও তা এখনো প্রণয়ন করা হয়নি। নতুন আইন ও পুরোনো বিধিমালা অনুসারে বিআরটিএ দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাচ্ছে।

বিআরটিএর পর সড়ক আইন কার্যকরে বড় ভূমিকা পুলিশের। কিন্তু তাদের মামলা করার যন্ত্রের সফটওয়্যার হালনাগাদ করা হয়নি। এ কারণে সড়কে আইন অমান্যের জন্য তারা জরিমানা ও মামলা করতে পারছে না। তবে নতুন সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী বিভিন্ন অপরাধের সাজা উল্লেখ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। মাইকে প্রচারও চালানো হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া নতুন সড়ক আইন অনেকটা কাগজেই রয়ে গেছে। জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আইনটির প্রয়োগ এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছিলেন। এই নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার প্রাক্কালে গত বৃহস্পতিবার বনানীর বিআরটিএ কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা করেন ওবায়দুল কাদের। ওই বৈঠকে নতুন আইন কার্যকর করার সময় আরও এক সপ্তাহ বাড়ানোর ঘোষণা দেন মন্ত্রী।

পুরোনো আইনে চালকের লাইসেন্স পাওয়ার পরীক্ষার সিলেবাস ও ফি বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। কিন্তু নতুন আইনে এই দুটি বিষয়ের উল্লেখ নেই। তবে নতুন আইন অনুযায়ী চালকের লাইসেন্স পাওয়ার সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি বিআরটিএ কার্যকর করছে। কিন্তু চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা এখনো আগের আইন অনুযায়ী হচ্ছে বলে বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে।

>

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮
এখনো বিধিমালা হয়নি
পুরোনো ও নতুন আইন মিলিয়ে বিআরটিএর দৈনন্দিন কাজ চলছে

মোটরসাইকেলের জন্য কোনো ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। নতুন প্রাইভেট কার নিবন্ধনের সময় পাঁচ বছরের জন্য ফিটনেস সনদ পেয়ে থাকে। বাকি সব যানবাহন চলাচলের জন্য প্রতিবছর ফিটনেস সনদ নিতে হয়। পুরোনো আইনে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নতুন আইনে ফিটনেসের মেয়াদ কত দিনের হবে, তা বলা নেই। ফলে বিআরটিএ এখনো পুরোনো আইনেই ফিটনেস সনদ দিচ্ছে। এ ছাড়া গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়ার জন্য মহানগর ও জেলাগুলোতে পরিবহন কমিটি রয়েছে। পুরোনো আইনে কমিটি তিন বছরের জন্য চলাচলের অনুমতি দিতে পারে। এরপর তা নবায়ন করতে হয়। তবে নতুন আইনে অনুমোদনের মেয়াদ উল্লেখ নেই।

বিআরটিএর চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ছোটখাটো কিছু দুর্বলতা তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। নতুন বিধিমালায় সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সড়ক পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মালেকের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে। শিগগিরই তা চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

বিধিমালা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত সূত্র বলছে, নতুন আইনে মোটরযানের নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়েও জটিলতা আছে। পুরোনো আইনে নিবন্ধন নম্বরের আগে সংশ্লিষ্ট জেলা বা মহানগরের নাম জুড়ে দেওয়ার বিধান রয়েছে। যেমন ঢাকা মহানগরের জন্য নিবন্ধন চিহ্ন হচ্ছে ‘ঢাকা মেট্রো’, চট্টগ্রাম মহানগরের জন্য ‘চট্টঃ মেট্রো’। কিন্তু নতুন আইনে এই বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে বিআরটিএ এখন নিবন্ধন দিচ্ছে আগের আইনের নির্দেশনা মেনে।

পুরোনো ও নতুন—দুই আইনেই মোটরযান চালানোর নিয়ম মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। তবে নতুন আইনে সেই নিয়ম কী কী, তা উল্লেখ নেই। পুরোনো আইনে নবম তফসিল নামে কয়েক পাতার নির্দেশনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ট্রাফিক সিগন্যাল ও সাইনের ছবি দিয়ে কোনটি মানতে হবে এবং কীভাবে তা ব্যবহার করা হবে, এর নির্দেশনা রয়েছে।

সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পুলিশ ও বিআরটিএর। পুলিশ সড়কে আইন অমান্য করার দায়ে মামলা ও জরিমানা করে থাকে। অন্যদিকে বিআরটিএর দায়িত্ব হচ্ছে আইন মেনে মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা বদলি, ফিটনেস প্রদান করা। লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও বাতিল করাও বিআরটিএর কাজ। আইনি জটিলতার কারণে বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়। এক বছরের বেশি সময় পর গত ২৪ অক্টোবর আইন কার্যকরের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেই অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হলেও এখনো তা পুরোপুরি প্রয়োগ শুরু হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক কাজী সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সচেতনতা সৃষ্টি ও আইনের অস্পষ্টতার বিষয়গুলো নিয়ে অনেক আগে থেকে কাজ শুরু করা দরকার ছিল। জোরেশোরে প্রচার চালিয়ে এবং অস্পষ্টতা সমাধান করে দ্রুত আইনটি প্রয়োগ করা জরুরি।