কক্সবাজারে ৫৭ গ্রামে পানি

ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূল প্রচণ্ডভাবে উত্তাল হয়ে পড়েছে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। আজ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় অন্তত ৫৭ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

টানা তিন দিনের ছুটি থাকায় এই পর্যটন শহরে এবার ব্যাপক ভিড় থাকবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে বৈরী আবহাওয়ায় আজ দুপুর থেকেই সাগরে গোসল বন্ধ করে দেয় ট্যুরিস্ট পুলিশ। এরপর থেকে সৈকত ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। এখন এই পর্যটন শহরে থাকা প্রায় ১০ হাজার মানুষ হোটেল কক্ষে একপ্রকার বন্দী হয়ে আছে।

আজ সকাল থেকে হালকা বৃষ্টিপাত শুরু হয়। বিকেল চারটা থেকে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। এ সময় দমকা হাওয়াও বইতে থাকে। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে চার-পাঁচ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলে আছড়ে পড়ছে। জোয়ারের ধাক্কায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আজকের প্লাবনে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি পানিবন্দী রয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূলে ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হচ্ছে।

পাউবো ও উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বুলবুলের প্রভাবে কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবর ডেইল, লেমশিখালী, কৈয়ারবিল ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জোয়ারে পানিতে ডুবে গেছে তিন শতাধিক ঘরবাড়ি। এই উপজেলার ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে ভাঙা রয়েছে ১৩ কিলোমিটার। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ঘরবাড়ি সয়লাব হয়েছে।
একইভাবে মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নের প্রায় এক কিলোমিটার ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে সাইরার ডেইল, সুতরিয়াপাড়াসহ ছয়টি গ্রাম। ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, সন্ধ্যার দিকে জোয়ারের সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। ঝুঁকিতে থাকা লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হচ্ছে। উপজেলার মাতারবাড়ী, কুতুবজোম ইউনিয়নেও ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফের ছয়টি, পেকুয়ায় ছয়টি, চকরিয়ায় পাঁচটি ও কক্সবাজার সদরে তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় পাউবোর বেড়িবাঁধ রয়েছে প্রায় ৫৯৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুতুবদিয়ায় ১৩ কিলোমিটার এবং মহেশখালীতে ৮০০ মিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণভাবে ভাঙা রয়েছে। ভাঙা বেড়িবাঁধের পাশাপাশি কিছু বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। সমুদ্রের জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধের উচ্চতার চেয়েও বেশি হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

হোটেল কক্ষে আটকা ১০ হাজার পর্যটক
কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসা অন্তত ১০ হাজার পর্যটক হোটেলে অলস সময় পার করছেন। বৈরী পরিবেশ উপেক্ষা করে সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কয়েক শ পর্যটক উত্তাল সমুদ্রে নেমে আনন্দ-উল্লাস করেন। বিকেল চারটার পর ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী বর্ষণ শুরু হলে অধিকাংশ পর্যটক হোটেল কক্ষে ফিরে যান।
রাত আটটার আগেই যেন সব পর্যটক সৈকত ত্যাগ করেন—এই আহ্বান জানিয়ে বেলা দুইটার দিকে ট্যুরিস্ট পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচার চালানো হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় রাতের বেলায় সৈকতে অবস্থান করা কারও জন্য নিরাপদ নয়।
পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ট্যুরিস্ট পুলিশের সুপার মো. জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উত্তাল সমুদ্র দেখেও অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপ দিচ্ছেন। বাঁশি বাজিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বাধা দিয়েও তাদের থামানো যাচ্ছে না। তবে দুপুরের পর থেকে কাউকে গোসলে নামতে দেয়নি পুলিশ। এ কারণে সৈকত কিছুটা ফাঁকা হয়ে পড়েছে। তবে রাত আটটার পর কাউকে সৈকতে থাকতে দেওয়া হবে না মর্মে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কেউ অমান্য করলে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হবে। কারণ নিরাপত্তা আগে।
দেখা গেছে, বৈরী পরিবেশে হাজারো পর্যটক হোটেল কক্ষে বসে অলস সময় পার করছেন। তবে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে কক্সবাজার মুক্ত থাকায় পর্যটকদের মধ্যে তেমন আতঙ্ক নেই।

নিরাপদ আশ্রয়ে মাছ ধরার ট্রলার
জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, আজ বিকেলের মধ্যেই সব নৌযান গভীর সাগর থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে উপকূলে ফিরে এসেছে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাব কেটে গেলে জেলেরা পুনরায় ট্রলার নিয়ে সাগরে নামবেন ইলিশ আহরণে। জেলার আটটি উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় ছয় হাজার ট্রলারের জেলে রয়েছেন এক লাখের বেশি।

জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি
কক্সবাজার আবহাওয়া দপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। কক্সবাজারে ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত রয়েছে। মাছ ধরার সব নৌযানকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি হিসেবে জেলার ৫৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা রাখার পাশাপাশি লোকজনকে সরিয়ে নিতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে প্রায় সাত হাজার স্বেচ্ছাসেবক।
টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত আছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ অন্তত পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক।