পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি ৫৬ বছরেও

চট্টগ্রাম নগরের ১৬টি প্রধান খাল দিয়ে প্রতিদিন পয়ো ও গৃহস্থালির বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে মিশছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
চট্টগ্রাম নগরের ১৬টি প্রধান খাল দিয়ে প্রতিদিন পয়ো ও গৃহস্থালির বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে মিশছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী সেতু এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

ক্রমাগত মানুষ বাড়ছে চট্টগ্রাম শহরে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বর্জ্যও। কিন্তু দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই শহরে নেই কোনো পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা। এ জন্য পয়ো ও গৃহস্থালি বর্জ্যসহ দূষিত পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে। এতে দূষিত হচ্ছে নদী দুটি, হারিয়ে যাচ্ছে মাছ।

পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব চট্টগ্রাম ওয়াসার। এই সংস্থাটির প্রধান তিনটি লক্ষ্যের একটি পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং তা পরিচালনা ও সংরক্ষণ করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৫৬ বছরেও পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি সংস্থাটি।

পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার পেছনে কয়েকটি কারণের কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত এ রকম প্রকল্প বাস্তবায়ন করা খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু সে অনুযায়ী দাতা সংস্থা মেলে না। অন্যদিকে ওয়াসার চেষ্টারও ঘাটতি ছিল। কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন বেশ জটিলও। নতুন করে পাইপলাইন স্থাপনের জন্য সড়কে গভীর খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজন পড়ে। এতে দীর্ঘমেয়াদি জনদুর্ভোগ তৈরি হয়। সে জন্য পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থার চেয়ে পানি উৎপাদনের দিকেই বেশি নজর দেয় সংস্থাটি।

তবে সম্প্রতি পয়োনিষ্কাশনের একটি প্রকল্প পেয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। কিন্তু ২০২৫ সাল নাগাদ সেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেও তেমন বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ মাত্র ১২ লাখ মানুষ এই প্রকল্পের আওতায় আসবে। অথচ নগরে জনসংখ্যা বর্তমানে ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে।

ওয়াসার দুর্বলতার কারণেই এত বছর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়নি বলে স্বীকার করেছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম ফজলুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় কর্ণফুলী ও হালদা দূষিত হচ্ছে। অল্প বৃষ্টিতেই শহরে পানি উঠে যাচ্ছে। আবার সেই পানির মধ্যে মলমূত্র ভেসে বেড়ায়। এতে করে রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে।

এ কে এম ফজলুল্লাহ আরও বলেন, একটি জোনের পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। অন্য জোনগুলোর প্রকল্প যেন বাস্তবায়ন করা যায়, সে জন্য দাতা সদস্য খোঁজা হচ্ছে।

দূষিত হচ্ছে কর্ণফুলী–হালদা
পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য—উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ঢাকার চারপাশের নদী এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দূষণরোধ, নাব্যতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ দখল উচ্ছেদের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি আলোচিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তখনকার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে এসব বিষয়ে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করা হয়।

সেই কমিটির চট্টগ্রামের জন্য প্রণীত খসড়া মহাপরিকল্পনায় বলা হয়, কর্ণফুলী নদীদূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছে পয়োবর্জ্য। চট্টগ্রাম মহানগরের বাসিন্দাদের পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো প্রকল্প না থাকাই এর প্রধান কারণ।

সেই মহাপরিকল্পনায় আরও বলা হয়, নগরের ১৬টি প্রধান খাল দিয়ে প্রতিদিন পয়ো ও গৃহস্থালির বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে মিশছে। পয়োবর্জ্যসহ ২৫ কোটি লিটার দূষিত পানি বিভিন্ন খালের মাধ্যমে প্রতিদিন কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাবে প্রতিদিন নগরে ১ হাজার ২০০ টন গৃহস্থালির বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ১ হাজার টন বর্জ্য করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সংগ্রহ করেন। বাকিগুলো নালা-নর্দমা দিয়ে কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ে।

কর্ণফুলী নদীদূষণের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে মাছ। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত আবদুল লতিফ ভূঁইয়ার করা এক গবেষণায় দেখা যায়, সে সময় কর্ণফুলী নদীতে মিশ্র পানির ৫৯ প্রজাতির, মিঠা পানির ৬৬ প্রজাতির এবং পরিযায়ী ২৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এই গবেষণাকে ভিত্তি ধরে ২০০৯ সালে কর্ণফুলী নদীর মাছ এবং দূষণের ওপর আরেকটি গবেষণা করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া। তখন দেখা যায়, মিশ্র পানির ২৫ প্রজাতির, মিঠা পানির ৩০ প্রজাতির এবং পরিযায়ী প্রজাতির মাছ প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কর্ণফুলী নদী থেকে।

শুধু কর্ণফুলী নয়, একই কারণে দূষিত হচ্ছে হালদা নদীও। অথচ এ দুটি নদীই ওয়াসার পানির একমাত্র উৎস। দুই নদীর পানি পরিশোধন করেই ওয়াসা পানি সরবরাহ করছে।

অবশেষে একটি প্রকল্প
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পুরো শহরকে ছয়টি জোনে ভাগ করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর মধ্যে জোন-১–এর অধীনে ‘চট্টগ্রাম মহানগরের প্রথম পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেকে অনুমোদন পায়। নগরের হালিশহর, আগ্রাবাদ, নিউমার্কেট, লালখান বাজার, জামালখান, কোতোয়ালি অর্থাৎ শহরের পশ্চিম অংশের ৭২ হাজার ৫০২টি বাড়ি এই প্রকল্পের অধীনে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় আসবে। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে বর্তমানে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী ১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৮টি হোল্ডিং (গৃহ) রয়েছে। ৩ হাজার ৮০৮ কোটি ৫৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকার এই প্রকল্পটি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান আসিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা না থাকায় ময়লা-আবর্জনা সব কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে। আবার সেই নদীর পানি আমরা পান করছি। ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খাওয়ার কারণে হয়তো জনস্বাস্থ্যের তেমন ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু সরাসরি পান করলেই প্রভাব পড়ে। ২০১৮ সালে হালিশহরে পানিবাহিত রোগে কয়েকজনের মৃত্যু সেটিই দেখিয়ে দিয়েছিল।’