বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে

বাংলাদেশের উপকূলের সুরক্ষা দেয়াল সুন্দরবনে একের পর এক বিপদ আসছে। ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে আশপাশের নানা অবকাঠামোর চাপেও আছে এই বন। এত বাধা সত্ত্বেও এখানে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর সুন্দরবন শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়।  ছবি: শিশির মোড়ল
বাংলাদেশের উপকূলের সুরক্ষা দেয়াল সুন্দরবনে একের পর এক বিপদ আসছে। ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে আশপাশের নানা অবকাঠামোর চাপেও আছে এই বন। এত বাধা সত্ত্বেও এখানে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৯ ডিসেম্বর সুন্দরবন শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়। ছবি: শিশির মোড়ল

দেশে বনের বাইরে ও ভেতরে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বনের বাইরের গাছ। বনভূমিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে সুন্দরবন। আর দেশের বনভূমির আশপাশে থাকা মানুষেরা বন থেকে যে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে, তার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ‘বাংলাদেশের বনভূমি ও বৃক্ষ সম্পদ সমীক্ষা প্রতিবেদন-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

তিন বছর ধরে চলা নতুন এই সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, যা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হিসাবে বনের বাইরের গাছ আমলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু নতুন সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বনের বাইরে গাছের পরিমাণ মোট ভূমির ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এসব গাছের বেশির ভাগই বেড়ে উঠেছে মূলত সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে। এ ছাড়া রয়েছে বাণিজ্যিকভাবে লাগানো গাছ, ফলবাগান ও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় সরকারি-বেসরকারি জমিতে রোপণ করা গাছ। সেই হিসাবে বনের ভেতর ও বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির সাড়ে ২২ শতাংশ।

বনভূমি নিয়ে নতুন সমীক্ষাটি করেছে বাংলাদেশের বন বিভাগ। প্রথমবারের মতো করা এই সমীক্ষায় কারিগরি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বন বিভাগ, মহাকাশবিষয়ক গবেষণা সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্রান্সের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্র। সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং জাতিসংঘের এফএও। দেশের ৩০টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিল। ২০১৬ থেকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময়ে সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

নতুন সমীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের গ্রামের হাটগুলোতে এখন অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাশাপাশি গাছের চারা কেনাবেচা হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে যে বৃক্ষরোপণ দেশে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের উপকূলীয় বনায়নের পাশাপাশি প্রতিটি অবকাঠামো প্রকল্পের মধ্যে বৃক্ষরোপণকে যুক্ত করা হচ্ছে। যেমন রাস্তা, বাঁধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবখানে গাছের জন্য জায়গা রাখা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের সফলতাই এখন আমরা পাচ্ছি। তবে আমাদের এখন খেয়াল রাখতে হবে, আমরা যাতে বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতি বাদ দিয়ে দেশীয় ফল ও ঔষধি গাছ বেশি লাগাই, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।’

ঘাটতি আড়াই শতাংশ বনভূমি

নতুন সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনের বাইরে যেসব এলাকায় গাছ বেড়েছে, তার বেশির ভাগই গ্রামের মানুষের রোপণ করা ঘরের চারপাশের বাগান, বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপন করা ফলবাগান এবং সামাজিক বনায়ন। এ ছাড়া নতুন জেগে ওঠা উপকূলীয় চরে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে অনেক নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা সোনাদিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ, বঙ্গবন্ধুর চরসহ অনেক নতুন ভূখণ্ড বনভূমিতে পরিণত হয়েছে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি রাখতে হবে। বনভূমির সংজ্ঞা হিসেবে জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছে, প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ শতাংশ এলাকায় বৃক্ষ থাকতে হবে এবং সেগুলোর উচ্চতা ৫ মিটার হতে হবে। তবেই ওই এলাকাকে বনভূমি বলা যাবে। ওই সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এফএও থেকে প্রকাশিত বিশ্ব পরিসংখ্যান পকেট বুক অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মোট বনভূমির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের বনভূমির পরিমাণ ২৫ শতাংশে উত্তীর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। আমাদের দেশ অনেক ছোট, জনসংখ্যাও বেশি। ফলে জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২৫ শতাংশ বনভূমি করা কঠিন। আমরা বনের ভেতরে ও বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকাকে বন এলাকা হিসেবে ধরে নিয়ে এগোচ্ছি। সেই হিসাবে আমাদের এখন মোট বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। আমাদের ঘাটতি আছে আড়াই শতাংশ।’

আহরণ করা সম্পদের আর্থিক মূল্য বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশের বনভূমির ওপর নির্ভরশীল রয়েছে কয়েক কোটি মানুষ। যারা বনভূমি থেকে বৃক্ষ, ফল, মাছসহ নানা সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সমীক্ষাটিতে প্রতিবছরে এমন সম্পদের একটি আর্থিক হিসাব করা হয়েছে, যার মোট পরিমাণ ২০ হাজার ২৯২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বনের আশপাশের অধিবাসীরা বনভূমি থেকে বছরে গড়ে ৯ হাজার ১৬০ টাকা আয় করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয় সুন্দরবনের পাশের অধিবাসীদের। মূলত খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও বরিশালের প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। তারা মাথাপিছু ওই বন থেকে বছরে ২৮ হাজার ৬৩৯ টাকা আয় করে।

সুন্দরবনের আশপাশের অধিবাসীরা সুন্দরবন থেকে যে আয় করে, তার ৭৮ শতাংশ আসে মাছ থেকে। সেখানকার অধিবাসীরা সুন্দরবন থেকে মাছ ও কাঁকড়ার পাশাপাশি চিংড়ির পোনাও সংগ্রহ করে থাকে। এর পাশাপাশি গোলপাতা ও মধু সংগ্রহ করে থাকে তারা। সুন্দরবনের আশপাশের বসতি এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে গোলপাতাসহ নানা ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে, যা সেখানকার বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বৃদ্ধি করছে ও স্থানীয়দের আয় বাড়াচ্ছে।

এ ব্যাপারে বন বিভাগের সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলে নতুন জেগে ওঠা চরসহ ফাঁকা জমিতে গাছ লাগানোর বিষয়টি বন বিভাগ দেশে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এ ছাড়া গ্রামের মানুষ গাছকে তার ‘সামাজিক বিমা’ হিসেবে দেখে। মূলত গাছের বিক্রয়মূল্যের জন্য গাছ লাগানোতে মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্য ভালো হচ্ছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেশে বৃক্ষ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে গ্রামের মানুষের কাঠ ও ফলের গাছ লাগানোর প্রবণতা বেড়ে যাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আম ও মেহগনিগাছের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে। বাণিজ্যিকভাবে গ্রামের মানুষ আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারার মতো গাছ রোপণ করছে। একই সঙ্গে গ্রামের ফসল কম হয়, এমন জমিগুলোতে মেহগনিগাছ বেশি রোপণ করছে। বিশেষ করে গত এক যুগে রাজশাহী বিভাগের বেশির ভাগ জেলা ও সাতক্ষীরা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ফলবাগানের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে। এসব গাছের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতাও বেশি।

তবে দেশের বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় কী পরিমাণ গাছ কমেছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট হিসাব ওই প্রতিবেদনে দেওয়া হয়নি। বিশ্বের বনজ সম্পদ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ-২০১৯–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর সমপরিমাণ এলাকার বনভূমি উজাড় হয়েছে।

সুন্দরবনে তিন কোটি টন কার্বন বেড়েছে

কোনো একটি বনে বৃক্ষ সম্পদের অবস্থা বোঝার জন্য বিশ্বজুড়ে নতুন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তা হচ্ছে ওই বনের বৃক্ষ সম্পদের মধ্যে কী পরিমাণ কার্বন মজুত আছে। বাংলাদেশে একমাত্র সুন্দরবনের কার্বনের মজুত নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়েছিল ২০০৯ সালে। ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, সুন্দরবনে কার্বন মজুতের পরিমাণ ১০ কোটি ৬০ লাখ টন। ২০১৯ সালের নতুন এই সমীক্ষায় কার্বন মজুতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৬০ লাখ টনে।

জানতে চাইলে বন ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রথম বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশের বৃক্ষ সম্পদের ওপর এই সমীক্ষা করা হয়েছে। আগের সব তথ্য–উপাত্তের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, বনের ভেতর ও বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বেড়েছে। এতে দেশের বনভূমির সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে।

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের যে কটি বন আছে, তার মধ্যে সুন্দরবনের ক্ষতি কম হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সুন্দরবনের বৃক্ষ সম্পদ বেড়েছে। এটি এই বনের প্রাকৃতিক শক্তিমত্তার পরিচয়। তবে এর চারপাশে শিল্পকারখানা ও অবকাঠামোর যে চাপ বাড়ছে, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে এই বনের প্রাকৃতিক সম্পদকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। তাই সরকারের উচিত সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের তৎপরতা বন্ধে কঠোর হওয়া।’