বিচ্ছিন্ন গ্রাম, নানা সংকট

কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চারদিকে নদীঘেরা চরনোয়াগাঁও গ্রাম। সাম্প্রতিক ছবি।  প্রথম আলো
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চারদিকে নদীঘেরা চরনোয়াগাঁও গ্রাম। সাম্প্রতিক ছবি। প্রথম আলো

চারদিকে নদীঘেরা গ্রাম। নাম চর নোয়াগাঁও। এই গ্রামে যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। শুকনো মৌসুমে কাঁঠালিয়া নদী পার হয়ে খেতের আল ধরে হেঁটে এবং বর্ষায় নৌকায় চড়ে গ্রামবাসীকে কাশিপুর হয়ে মেঘনা সদরে যাওয়া-আসা করতে হয়।

গ্রামটি অবস্থিত কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নে। চর নোয়াগাঁও গ্রামের চারপাশ ঘিরে আছে কাঁঠালিয়া নদী। প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে আর কোনো গ্রাম নেই। ৪৫ পরিবারের তিন শতাধিক মানুষ বসবাস করে এই গ্রামে। এখানে নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক। এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদেরও এ গ্রামে যাতায়াত নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে রোগবালাই হলে হাতুড়ে ডাক্তার আর ওঝা-কবিরাজের ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করতে হয় গ্রামবাসীকে।

এই গ্রামের মাত্র তিনজনের নিজস্ব নৌকা আছে। বর্ষাকালে যাতায়াতের জন্য গ্রামের অন্য বাসিন্দাদের নির্ভর করতে একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা সার্ভিসের ওপর। সকাল আটটা থেকে গ্রামের বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিনের ছোট শ্যালো নৌকায় চর নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দাদের কাশিপুর গ্রামের কাছে নদীর তীরে নামিয়ে দেওয়া হয়। তবে সেটিই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটিমাত্র ইঞ্জিনচালিত নৌকা থাকায় নদী পার হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।

চর নোয়াগাঁও গ্রামটি একটি দ্বীপের মতো। বর্ষা মৌসুমে রাতে ডাকাত দল ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে হানা দেয়। ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে গ্রামবাসীকে রাত জেগে পাহারা দিতে হয়।

গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ২৫। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য নদী পার হয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের যেতে হয় মানিকারচর এলএন উচ্চবিদ্যালয়ে। চর নোয়াগাঁও গ্রাম থেকে মানিকারচরের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেকের পক্ষে, বিশেষ করে, মেয়েদের আর এই দূরত্ব অতিক্রম করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।

এই গ্রামের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী তানিয়া আক্তার বলে, গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালের শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় চারজন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।

চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র জাহিদ বলে, তাদের শ্রেণিতে চারজন ও তৃতীয় শ্রেণিতে সাতজন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।

এই গ্রামের বাসিন্দা নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ কলেজে বিএসএস প্রথম বর্ষের ছাত্র সুমন বলেন, তিনি গ্রামের স্কুল থেকে ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন। তখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল ১৩ জন। এখন মাত্র চারজন। দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের অভাবে দিন দিন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গ্রামের একমাত্র বিএসএসপড়ুয়া ছাত্র তিনি। এর আগে এ গ্রামের কেউ বিএ পাস করেনি।

গ্রামের গৃহবধূ হাসনা বেগম বলেন, দারিদ্র্যের কারণে তাঁর দুই ছেলে শাহ আলম ও আবু তাহেরকে পঞ্চম শ্রেণির বেশি লেখাপড়া করাতে পারেননি। একমাত্র মেয়ে সালমা কাঁঠালিয়া নদী পার হয়ে পাশের ব্রাহ্মণচর মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে পড়ছে। 

আরেক গৃহবধূ আঁখি আক্তার বলেন, এই গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে দেড় বছর আগে। তবে গ্যাস নেই। গ্রামের বাসিন্দাদের নিজস্ব জমি নেই। তাঁদের অন্যের জমিতে দিনমজুরি করতে হয়।

চর নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি আবদুস সাত্তার বলেন, দারিদ্র্যের কারণে এই বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাজেদা আক্তার বলেন, বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার যোগাযোগ সমস্যাই প্রধান। দারিদ্র্যের কারণে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেলেও বিদ্যালয়টি টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লায়লা পারভীন বলেন, এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে দুজন শিক্ষক পাঠদান করছেন।