ঢাকায় নকল সুরের ভোটের গানে 'প্রাণ' যায়

ঢাকার দুই সিটিতে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি চলছে ‘ভোটের গান’। ছবি: আবদুস সালাম
ঢাকার দুই সিটিতে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি চলছে ‘ভোটের গান’। ছবি: আবদুস সালাম

দূষণ আর যানজটের শহর ঢাকাকে এখন ‘সংগীতের নগর’ বললেও ভুল হবে না। জনপ্রিয় বিভিন্ন গানের সুর নকল করে দুই সিটি নির্বাচনের প্রার্থীদের নিয়ে প্যারোডি গানে মুখর শহরের অলিগলি। গানে গানেই চলছে প্রার্থীর গুণকীর্তন আর মার্কার (প্রতীক) জয়গান।

আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সকাল থেকে তো বটেই; কোথাও কোথাও মধ্যরাত অবধি চলছে ‘ভোটের গান’। যেগুলোর প্রায় সবই তৈরি হয়েছে কপিরাইট আইনের তোয়াক্কা না করে। প্রচারের এই চলতি ধারা নির্বাচনে একদিকে যেমন বাড়তি রং যোগ করছে, তেমনি দিন–রাত উচ্চ স্বরে বাজানো গান অনেকের কানে পৌঁছাচ্ছে রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সংগীতকে চমৎকার দাওয়াই হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এ ক্ষেত্রে তা খাটছে না।

ভোট চেয়ে বাজানো এসব গানের ‘অত্যাচারে’ অতিষ্ঠ মিরপুরের আলী আশরাফ নামের এক ব্যক্তি সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দয়া করে গান থামান। না হলে স্ট্রোক করে মারা যাব। মরে গেলে তো আর ভোট দিতে যেতে পারব না।’ এসব গানের বিষয়ে নগরবাসীর রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

যেসব গানের চল বেশি

সুর নকল করে গাওয়া যেসব প্যারোডি গান এখন বেশি শোনা যাচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে ‘দে দে সিল মেরে দে, তোরা দেরি করিস না/ নৌকা মার্কা ছাড়া তোরা সিল মারিস না’। আবার ‘সবাই মিলে ভোট দেব ধানের শীষে/ ধানের শীষে আছে রক্ত মিশে’। কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে বাজছে, ‘আপা গো তোমার ভোটটা দিয়ে দাও/ করাত মার্কায় তুমি তোমার ভোটটা দিয়ে দাও’; ‘১ তারিখের নির্বাচনে সবাই শপথ নিয়ো/ নির্বাচনে ভোটটা মিষ্টি কুমড়া মার্কায় দিয়ো’; ‘১১ নম্বর ওয়ার্ডে একটা মার্কা রয়েছে/ কুমড়া মার্কার পক্ষে নাকি জোয়ার এসেছে’—এ রকম নানা গান।

>

দিন-রাত উচ্চ স্বরে বাজানো গান অনেকের কানে পৌঁছাচ্ছে রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে

এ ছাড়া দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া হচ্ছে, ‘আইল গেল কত ভাই, উন্নয়নের বালাই নাই/ অমুক ভাই, তমুক ভাই, চলেন সবাই ভুইলা যাই/ জনি ভাইয়ের সালাম নিন, ঘুড়ি মার্কায় ভোট দিন’। আবার র‌্যাপ সংগীতের আদলে ডিএনসিসির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আলেয়া সারোয়ারকে নিয়ে তৈরি একটি গান ছড়িয়ে পড়েছে (ভাইরাল) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গানের কথাগুলো এ রকম, ‘৩১ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে আপার কিছু কথা আছে/ প্রভাবশালীর প্রভাবে জনগণের মনের ব্যথা/ সন্ত্রাসবাদের আনাগোনা/ মাদকের আখড়া/ দখলের কবলে এলাকা/ নাই নাগরিক সুবিধা/ সোডিয়ামের আলো নাই/ নিরাপত্তার বালাই নাই/ জনগণের অধিকার পূর্ণ করার কি কেউ নাই?’।

কারা তৈরি করছেন এসব গান

ভোটের প্রচারে প্রার্থীকে নিয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত সুরে তৈরি গান ব্যবহারের চল আগেও ছিল। সাধারণত মাঠে–ঘাটে গান করে বেড়ানো লোকশিল্পীরা এসব করতেন। সময়ের বিবর্তনে আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রানুষঙ্গ সেই ধারাটি অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। এখন যে কেউ চাইলে চাহিদামতো গান তৈরি করিয়ে নিতে পারেন। এ জন্য একক কোনো শিল্পী কিংবা গানের দলের প্রয়োজন হয় না।

প্রার্থীদের পছন্দসই ‘ভোটের গান’ তৈরির জন্য এই মুহূর্তে সরগরম ঢাকার মগবাজার, পল্টন, বিজয়নগর ও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বেশ কয়েকটি রেকর্ডিং স্টুডিও। পল্টনের সাউন্ড মিউজিক রেকর্ডিং হাউস এবার ২২ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর জন্য ‘টিকাটুলী মোড়ে একটা হল রয়েছে’, ‘মধু হই হই’সহ কয়েকটি জনপ্রিয় গানের সুরের ওপর কথা বসিয়ে সাতটির মতো গান তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. জাহাঙ্গীর জানান, প্রতি গানের জন্য তাঁরা প্রার্থীদের কাছ থেকে দুই হাজার করে টাকা নেন। আর দ্বৈত কণ্ঠে কথামালা তৈরির জন্য নেন তিন হাজার টাকা।

পল্টনের কাজল প্রচার সেন্টারের স্বত্বাধিকারী হাবিবুর রহমান প্রতি গানের জন্য নিচ্ছেন তিন হাজার টাকা, কথামালার জন্য চার হাজার। এ পর্যন্ত ৪০ জন কাউন্সিলর প্রার্থীর প্রচারের গান তৈরি করেছেন তিনি। এ ছাড়া দুটি গান ও একটা কথামালা দিয়ে সাজানো প্যাকেজের জন্য তিনি নিচ্ছেন ১২ হাজার টাকা।

সুর নকল করে তৈরি এসব নির্বাচনী গানের বিষয়ে কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো গানের সুর বিকৃতি ও কথা পরিবর্তন করে মনমতো গান প্রচার করলে তা কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন। এর শাস্তি হিসেবে ৬ মাস থেকে ৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কোনো শিল্পী চাইলে এ বিষয়ে কপিরাইট অফিসে অভিযোগ করতে পারেন।’

মাইকিংয়ে বিধি মানার বালাই নেই

নির্বাচনী আচরণবিধিতে মাইক ব্যবহারের সময়সীমা রয়েছে। বেলা দুইটার আগে ও রাত আটটার পর মাইক বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। মাইকিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়গুলো দেখভালের জন্য উত্তর সিটির ওয়ার্ডগুলোতে ১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। তাঁরা যদি তাঁদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন না করেন, তাহলে তা দুঃখজনক।

প্রায় দিনভর মাইকে ও মিনিট্রাকে সাউন্ড সিস্টেম বসিয়ে ভোটের গানের ‘অত্যাচারের’ বিষয়ে গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা কাজী জাফর আহমেদের বক্তব্য, নির্বাচনের আগেই প্রার্থীরা নিয়মকানুনের ধার ধারছেন না। মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করছেন না। নির্বাচিত হলে তাঁরা কতখানি দায়িত্বশীল আচরণ করবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।