অবৈধ ভবন বৈধ করতে রাজউকে জরিমানার সুপারিশ

অনুমোদন ছাড়া বা নিয়মের ব্যত্যয় করে নির্মিত ভবন অপসারণ করাই বিধান। কিন্তু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় এমন ভবন এত বেশি যে এ নিয়ে বিকল্প চিন্তা করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। যার অংশ হিসেবে উচ্চ হারে জরিমানা দিয়ে অনুমোদনহীন ভবন বৈধ করার সুপারিশ এসেছে। সংস্থাটির প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের (২০১৬-২০৩৫) খসড়ায় এ সুপারিশ করা হয়েছে।

সুপারিশ অনুযায়ী, নির্মাণ ব্যত্যয়ের মাত্রার ওপর নির্ভর করবে জরিমানা। ব্যত্যয় করা অংশ ওই ভবন, পাশের ভবন ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকির কারণ না হলে শুধু জরিমানা দিয়েই অনুমোদনহীন ভবন বা ভবনের অংশবিশেষের বৈধতা পাওয়া যাবে। আর কোনো ধরনের ঝুঁকি থাকলে ভবনের কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে।

সুপারিশে নিয়ম বা বিধি ভেঙে নির্মাণ করা ভবনগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। শ্রেণিগুলো হলো নির্মাণ অনুমোদন না নেওয়ার পরও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করা হয়েছে; অনুমোদন নেওয়া হয়েছে, কিন্তু নকশার ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে; অনুমোদন নেওয়া হয়নি, পাশাপাশি নির্মাণের বিধিও অনুসরণ করা হয়নি। এই তিন শ্রেণির ভবন জরিমানা দিয়ে বৈধতা পাবে।

সুপারিশে ইমারত নির্মাণ ও বিধিমালা সংস্কার, ক্ষতিপূরণ দিয়ে ভবনের বৈধতা নেওয়ার ক্ষেত্রে পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন ও মূল্যায়ন কমিটি গঠন, বিচ্যুতি অনুযায়ী ফি নির্ধারণ, তদারকি কমিটি গঠনসহ বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তবে মহাপরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে, সরকারি জমি বা নাগরিক সুবিধার জন্য নির্ধারিত স্থান দখল করে, জলাশয় ভরাট করে, সিভিল এভিয়েশনের নির্ধারিত উচ্চতার সীমা লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করলে জরিমানা দিয়েও বৈধতা পাওয়া যাবে না।

>রাজউক এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ ভবনই কোনো না কোনো নিয়ম ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে।

বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) এই সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘সুপারিশটি ভালো। তবে খেয়াল রাখতে হবে, জরিমানা আদায়ের ক্ষেত্রে যেন দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি না হয়। সব ভবনের মালিক যেন সমান ব্যবস্থার সম্মুখীন হন। পাশাপাশি যেসব ভবনের সেট ব্যাক বা অবৈধ অংশ ভাঙা প্রয়োজন, সেটিও ভাঙতে হবে। এভাবে শহর ক্রমান্বয়ে পরিকল্পিতভাবে গড়ার দিকে যাবে। অন্যদিকে উচ্চমাত্রার জরিমানার কারণে অন্যরাও নিয়ম মানতে আগ্রহী হবেন।’

খসড়া ড্যাপের তথ্য অনুযায়ী, রাজউকের আয়তন ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকায় ২০০৬ সালে মোট স্থাপনা ছিল ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৪১২ টি। ২০১৬ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ২১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৪৬। এই সময়ে প্রতিবছর ৯৪ হাজার ৯৩৩টি নতুন স্থাপনা হয়েছে। কিন্তু রাজউক প্রতিবছর গড়ে সাড়ে চার হাজার ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। এই হিসাবে প্রতিবছর রাজউক এলাকায় প্রায় ৯০ হাজার স্থাপনা অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে।

ড্যাপ ছাড়াও ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত একটি পৃথক জরিপ করেছিল রাজউক। দুই তলার ওপর ২ লাখ ৪ হাজার ১০৬টি ভবনের ওপর পরিচালিত এই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবী এলাকার ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন; রামপুরা, মতিঝিল, খিলগাঁও এলাকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভবন; ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

তবে রাজউক এলাকায় বেশির ভাগ বহুতল ভবন (১০ তলার ওপর) হয়েছে এক থেকে দুই দশকের মধ্যে। এমন ভবনেও নকশার ব্যত্যয় আছে। গত এপ্রিলে বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক এলাকার বহুতল ভবনের ওপর পরিচালিত জরিপে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই জরিপ বলছে, রাজউক এলাকায় ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন আছে, যার ৮৪ শতাংশই নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণের পাশাপাশি অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণকে ‘ব্যাপক মাত্রার সমস্যা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া ড্যাপে। এমন প্রেক্ষাপটে খসড়া ড্যাপে বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন বা নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত সব ভবন অপসারণ করলে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।

বিপর্যয় ঠেকাতেই খসড়া ড্যাপে জরিমানা দিয়ে অনুমোদনহীন ভবন বৈধ করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্রিয়াধীন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম। তিনি জানান, যে এলাকা থেকে জরিমানা আদায় করা হবে, সেই এলাকার উন্নয়নে এই জরিমানার টাকা ব্যয় করা হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদনহীন বা নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা ভবনগুলো রাজউকের তদারকির অভাব ও অস্বচ্ছতার কারণেই হয়েছে। রাজউক যদি এই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে চায়, তবে সেটি গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো উচ্চবিত্তদের এলাকা দিয়েই শুরু করতে হবে। পাশাপাশি রাজউক ঠিকমতো কাজ করছে, নাকি অর্থের বিনিময়ে মানুষকে হয়রানি করছে, সেটি তদারকির জন্যও একটি কমিটি থাকতে হবে।