সুন্দরবনে মাছের নতুন পাঁচটি প্রজাতি

গবেষকেরা বলছেন, প্রথমবারের মতো সুন্দরবনে মাছের প্রজাতি শনাক্তকরণে ডিএনএ বার কোডিং পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে

সুন্দরবনে মাছের তালিকায় যুক্ত হলো আরও পাঁচটি নতুন প্রজাতি। এসব মাছ সচরাচর দেখা যায় না। এর মধ্যে একটি প্রজাতি বিশ্বে আগে অন্য কোথাও দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে গবেষকেরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে ৩২২টি প্রজাতির মাছের খোঁজ পেয়েছেন।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ জলসীমায় মাছের প্রজাতি ও সংরক্ষণ পরিস্থিতি নিয়ে করা দুই বছর ধরে চলা এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ বন বিভাগের সহায়তায় এ গবেষণা করেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগ। ডিএনএ বার কোডিংয়ের মাধ্যমে মাছের প্রজাতি শনাক্তকরণের এই কাজে গবেষণা সহযোগী হিসেবে ছিল কোরিয়ার সমুদ্রবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি গত ২৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী জার্নাল অব থ্রেটেন্ড ট্যাক্সাতে ছাপা হয়েছে।

২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবনের প্রধান নদ-নদী বলেশ্বর, শিবসা, পশুর, শেলা, কালিন্দী, খোলপেটুয়া থেকে গবেষকেরা মাছের নমুনা সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া জোয়ারে প্লাবিত হয় এমন কিছু এলাকা, সুন্দরবন–সংলগ্ন সামুদ্রিক আবাস, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবনের ভেতর বা তার কাছাকাছি বাজার থেকেও মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।

গবেষক দলের প্রধান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক কাজী আহসান হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, সনাতন পদ্ধতিতে গবেষকেরা মাছের গঠন ও বাহ্যিক আকৃতি দেখে নাম ও প্রজাতি শনাক্ত করেন। কিন্তু জীবনচক্র পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতা তৈরির কারণে এ পদ্ধতিতে এদের শনাক্ত করা বেশ জটিল। তাই সুন্দরবনের মাছের জীববৈচিত্র্য নিরূপণে এবারই প্রথম ডিএনএ বার কোডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর আন্তর্জাতিক জিন ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করে নতুন প্রজাতি শনাক্ত করা হয়।

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে থাকে, যা রেড লিস্ট নামে পরিচিত। আইইউসিএনের সর্বশেষ গ্লোবাল রেড লিস্ট অনুযায়ী বর্তমান জরিপে পাওয়া মাছের মধ্যে ১৩ প্রজাতির মাছ প্রায় বিপন্ন, ১০ প্রজাতির মাছ ঝুঁকির মুখে, ৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে।

এ বিষয়ে আইইউসিএনের এ-দেশীয় প্রতিনিধি রাকিবুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, মাছের প্রজাতি শনাক্তকরণে ডিএনএ বার কোডিং পদ্ধতি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করল। এই গবেষণা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার পরিকল্পনায় সহায়তা করবে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে ১৯৯৪ সালে আইইউসিএনের অধীনে সুন্দরবনের একটি অংশে পরিচালিত জরিপে মাছের ১৭৭টি প্রজাতি পাওয়া গিয়েছিল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটি প্রকল্পের জরিপের পর ২০০১ সালে সুন্দরবনে মাছের প্রজাতির একটি তালিকা হালনাগাদ করা হয়। সেখানে সুন্দরবনে মাছের ১৯৬টি প্রজাতির উল্লেখ রয়েছে। এরপর সুন্দরবনের মাছের জীববৈচিত্র্য নিয়ে বড় ধরনের আর কোনো গবেষণা হয়নি। আর ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএনের রেড লিস্ট অনুযায়ী সারা দেশে ১৫৩টি স্বাদুপানির মাছের প্রজাতির মধ্যে বিপন্ন ৬৪টি।

গবেষণার বিষয়ে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দিল, সুন্দরবন শুধু ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকেই আমাদের রক্ষা করছে না, বিশ্বের প্রাণিকুলের জন্য অন্যতম বড় আশ্রয়। তাই আমাদের এই বনকে রক্ষায় আরও গুরুত্ব দিতে হবে।’

নতুন পাঁচ প্রজাতি

গবেষণাটি বলছে, বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে দুবলার চরের আলোরকোল এলাকায় মাছের নতুন পাঁচটি প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

শক্ততুন্ডি হাঙর (Mustelus mosis): পিঠের দিকটা লালচে ধূসর এবং পেটের বা নিচের দিকটা হালকা সাদা রঙের। এদের দেহ তুলনামূলক ছোট, সরু ও লম্বাটে। নাকের অংশটি দীর্ঘ। ত্রিভুজাকার মুখে উন্নত ঠোঁটের ভাঁজ বেশ স্পষ্ট। ত্বক মোটামুটি মসৃণ।

হীরকপৃষ্ঠ পটকা (Lagocephalus guentheri): দেহের পাশের দিকে রুপালি-সাদা বন্ধনী (ব্যান্ড) থাকে। পৃষ্ঠীয় পাখনা ধূসর রঙের। লেজ গাঢ় খয়েরি। দেহ তুলনামূলক ছোট এবং দেহের পৃষ্ঠীয় দিকে, তলপেটে এবং গলায় অতি ক্ষুদ্র কাঁটা থাকে।

রাজা মুরি (Carangoides hedlandensis): দেহের পৃষ্ঠীয় দিক নীলাভ সবুজ এবং নিচের দিক রুপালি সাদা, পৃষ্ঠীয় নরম পাখনা কালো। তাদের কানকোতে কালো বিন্দু থাকে।

হলুদ তেজি তারা গজার (Uranoscopus cognatu): দেহের ওপরের দিক ধূসর ও নিচের দিক রুপালি। কানকোর ওপরের দিকের প্রান্তে একটি কাঁটা থাকে এবং নাসা রন্ধ্রের মুখে লম্বা নলাকার কপাটিকা থাকে।

বড় জালি পটকা (Chelonodon bengalensis): বঙ্গোপসাগরের নাম অনুসারে মাছটির নাম রাখা হয়েছে চেলোনোডনটপস বেঙ্গালেনসিস। গায়ের রং কালচে এবং পৃষ্ঠীয় দিকে জালের মতো ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে। এই প্রজাতি বিশ্বের অন্য কোথাও নেই।